373713

সারারাত মায়ের পায়ের কাছে বসেছিলেন তারেক রহমান

শৈশবেই হারিয়েছেন প্রিয় বাবা, স্বাধীনতার ঘোষক ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে। একমাত্র ভাই আরাফাত রহমান কোকোকেও হারিয়েছেন এক দশক আগে। এক-এগারো সরকারের রোষানলে পড়ে দেশত্যাগে বাধ্য হন। শুরু হয় নির্বাসন ও দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন। তার জীবনের সবচেয়ে আপনজন মমতাময়ী মা, আপসহীন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক খালেদা জিয়া। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।

মায়ের সান্নিধ্য পাওয়া আর নতুন বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে দেশে ফেরার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছিলেন তিনি। এরইমধ্যে মমতাময়ী মা খালেদা জিয়া হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। জরুরিভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। এদিকে তার দেশের ফেরার তারিখ চূড়ান্ত হয়। দীর্ঘ ১৭ বছর পর মাতৃভূমিতে ফিরলেন তারেক রহমান।

ঐতিহাসিক এই প্রত্যাবর্তনের মাত্র ছয়দিনের মাথায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ৩৭ দিন চিকিৎসা শেষে মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোরে না ফেরার দেশের পাড়ি জমান দেশের রাজনীতির আপসহীন নক্ষত্র খালেদা জিয়া।

বিএনপি ও মেডিকেল বোর্ডের সদস্যদের সূত্র জানায়, সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) রাতে হঠাৎই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। তার যাতে কোনো কষ্ট না হয় এ জন্য রাতে ব্যাথার ও ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়।

মেডিকেল বোর্ডের একজন সদস্য জানান, খালেদা জিয়া ‘গভীর ঘুম’ অবস্থায় ছিলেন। যখন আমরা দেখি ব্লাড প্রেশার একদমই ধরে রাখা যাচ্ছিল না, তখন ব্লাড প্রেশারের ওষুধ দেওয়া হয় যাতে ব্লাড প্রেশারটা ধরে রাখা যায়। যেহেতু ভ্যান্টিলেশনে ছিলেন, অনেক সময় দেখা যায় অস্বস্তি হয়। যাতে কোনো অস্বস্তি না হয়, কোনো কিছু যাতে টের না পান, এ জন্য ঘুমের ওষুধ দেওয়া ছিল। এভাবেই আস্তে আস্তে চলে গেছেন …।

ফ্যামিলি মেম্বাররা যথেষ্ঠ সময় পেয়েছেন— পাশে থাকা, হাত ধরা, দোয়া করা। আমরা মাঝে মাঝে অ্যালাউ করতাম, মাঝে মাঝে করতাম না। ফ্যামিলি মেম্বার যারা মানিয়ে নিতে পারতেন, তারা প্রচুর সময় দিয়েছেন।

মেডিকেল বোর্ডের একাধিক সদস্য জানান, ১ ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার ভ্যান্টিলেশন টিউব লাগানো হয়। এরপর আর কারও সাথে কথা বলতে পারেননি। এর আগে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ছোট ছেলের স্ত্রী শামিলা রহমানের সঙ্গে অনেক কথা বলেছেন। ভাই শামীম ইস্কান্দারের সঙ্গে কথা-বার্তা বলতেন। খালেদা জিয়ার হেল্পিংহ্যান্ড ফাতেমার সঙ্গে কথা বলতেন। ভ্যান্টিলেশনে নেওয়ার আগ পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন, সময় কাটিয়েছেন। যখন ভালো থাকতেন, তখন টেকনিশিয়ান যারা আছেন তাদের সঙ্গে চিকিৎসার বাইরেও পরিবারের খোঁজ নিতেন।

এ প্রসঙ্গে মেডিক্যাল বোর্ডের একজন চিকিৎসক বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সঙ্গে আমরা একটা ফ্যামিলি বন্ডিংয়ে ছিলাম। ম্যাডাম জিজ্ঞেস করতেন— বাসার সবাই কেমন আছে, কার ছেলে কেমন আছে, বাচ্চা কেমন আছে। এই লেভেলের কমিউনিকেশন ছিল। শরীর ভালো থাকলে এমনভাবে কথা-বার্তা বলতেন। অনেকটা পারিবারিক আবহে। আমরা তো প্রায় ৫ বছর ধরে ম্যাডামের চিকিৎসায় সংযুক্ত ছিলাম। প্রফেশনের বাইরে গিয়েও আমরা একটা পরিবারের মতো হয়ে গিয়েছিলাম।

মেডিকেল বোর্ডের আরেক চিকিৎসক জানান, তারেক রহমান সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) সারাদিন নয়াপল্টনে নেতাকর্মীদের সাথে কুশল বিনিময় শেষে সন্ধ্যার পর হাসপাতালে আসেন। যতক্ষণ ছিলেন মায়ের পাশেই বসেছিলেন। রাত ২টার দিকে তারেক রহমান বাসায় চলে যান। তখন মনে হয়েছিল, রাতটা ম্যাডাম সারভাইভ করবেন। চেয়ারম্যান সাহেব (তারেক রহমান) বাসায় রেস্ট নিয়ে সকালে আসবেন, তখন দেখা যাবে। কিন্তু তিনি বাসায় গিয়ে রেস্টও নিতে পারেননি, সঙ্গে সঙ্গে আমরা কল করলাম। আর উনি চলে আসলেন। পুরোটা সময় তিনি মাড্যামের পায়ের কাছে, পেটের পাশে বসেছিলেন।

খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের সদস্য আইসিইউ কনসালট্যান্ট ডা. জাফর ইকবাল জানান, বিএনপি চেয়ারপারসনের ডায়ালায়সিস বন্ধ হলেই শারীরিক অবস্থার বেশ অবনতি হয়। স্বাস্থ্যের অনেক জটিলতা থাকায় বয়সের কারণে একসঙ্গে সব চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছিল না।

তিনি বলেন, সোমবার রাতে ম্যাডামের ব্লাড প্রেশার ওঠা-নামা করতে থাকে। উনি (তারেক রহমান) সব বুঝতে পারছিলেন, মনিটরের দিকে তাকাচ্ছিলেন— কখন ব্লাড পেসার ফল করছে, কখন হার্টবিট ফল করছে। উনি সব মনিটরে দেখছিলেন। মনিটর দেখেই বোঝা যাচ্ছিল রোগীর অবস্থা। ডাক্তারদের মুভমেন্ট দেখেই উনি (তারেক রহমান) মেসেজ পেয়ে যাচ্ছিলেন। মুখে বলতে হয়নি যে আপনার আম্মার শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

ডা. জাফর ইকবাল আরও বলেন, তারেক রহমান বারবার বলছিলেন, আপনারা (ডাক্তারদের) ৫ বছর ধরে আমার মাকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। আপনাদের ওপর আমার পরিবারের পক্ষ থেকে ফুল সাপোর্ট আছে। আপনারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন, করবেন জানি।

তারেক রহমান পুরোটা সময় বসেছিলেন। খুবই শান্তভাবে বসেছিলেন। আমাদের চিকিৎসায় কোনো ইন্টারফেয়ার করেননি। উনি বলে দিয়েছিলেন, কোনো কারণে আমাকে যদি বাইরে যেতে হয়, যাব। নিজে থেকেই দুই-একবার বাইরে গেছেন, পরীক্ষা করার সময়। ডাক্তাররা যখন পরীক্ষা করতেন তখন তিনি নিজ থেকে বাইরে গেছেন এবং পরীক্ষা শেষে আবার ভেতরে প্রবেশ করতেন। উনাকে বলতে হয়নি, আপনি বাইরে যান। উনি যথেষ্ঠ সেনসিবল মানুষ।

তারেক রহমান শুরু থেকেই খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ভার সম্পূর্ণরূপে মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে জানান বিএনপির সহ-স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. পারভেজ রেজা কাকন।

খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যালের বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার বলেছেন, খালেদা জিয়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। গত এক মাসের বেশি সময় তিনি এখানে ভর্তি ছিলেন। সুস্থতার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। কিডনি ভালো ছিল, কিন্তু ফুসফুসে ইনফেকশন হয়েছিল, যা তার পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।

মেডিকেলের বোর্ডের সদস্য আরেক সদস্য ডা. এফ এম সিদ্দিকী বলেন, ফুসফুসে ইনফেকশন হওয়ার পর খালেদা জিয়ার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়েছিল। এ জন্য ওষুধ কাজ করছিল না।

শেষ সময়ে হাসপাতালে খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান, নাতনি জাইমা রহমান, ছোট ছেলের বউ শামিলা রহমান সিঁথি, ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী, বড় বোন সেলিনা ইসলামসহ স্বজনরা।

শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গত ২৩ নভেম্বর ৮০ বছর বয়সী খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর ফুসফুস, হৃদযন্ত্র ও কিডনির অবস্থার দ্রুত অবনতি হওয়ায় ২৭ নভেম্বর তাকে নেওয়া হয় ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ)।

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শাহাব উদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে, ডা. জুবাইদা রহমানসহ দেশি-বিদেশি ৩০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড প্রতিদিন এভারকেয়ার হাসপাতালে খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন।

ad

পাঠকের মতামত