372025

স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীদের সুরক্ষায় ২ আইনের খসড়া করেছে সরকার

স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ও প্রতিষ্ঠান এবং রোগীদের সুরক্ষায় দুটি নতুন আইন প্রস্তাব করেছে সরকার। একটি ‘স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা অধ্যাদেশ–২০২৫’ এবং অপরটি ‘রোগী সুরক্ষা ও প্রতিকার অধ্যাদেশ–২০২৫’।

এই দুটি আইনের খসড়া আজ রোববার সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার জন্য উপস্থাপন করার কথা রয়েছে।

দেশব্যাপী চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এবং স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলার ঘটনা বাড়ছে। এমন সময়ে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এই দুটি খসড়া আইন প্রণয়ন করা হলো।

স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা অধ্যাদেশ আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, যদি কেউ পরিকল্পিতভাবে বা অন্যদের সঙ্গে মিলিত হয়ে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর হামলা বা সহিংসতা চালায়, কিংবা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করে, তাহলে তার সর্বোচ্চ ১০ বছরের জেল বা ১৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

আরও বলা হয়েছে, যদি এই ধরনের হামলায় কোনো স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু হয়, তাহলে সেই ব্যক্তি হত্যার জন্য ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।

অন্যদিকে, যদি কোনো স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বা চরম অবহেলার কারণে এমন কোনো কাজ করেন, যার ফলে রোগীর মারাত্মক ক্ষতি হয় বা মৃত্যু ঘটে, তাহলে সেটি একটি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এর শাস্তি হতে পারে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৭ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড।

সাধারণ অবহেলার কারণে কোনো ক্ষতি হলে তা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। এ ধরনের বিষয় দেওয়ানি প্রতিকার বা পেশাগত শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে।

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেছেন, আগের সরকারের সময়ে প্রণীত জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনের খসড়া অপর্যাপ্ত ছিল এবং এতে বেশ কয়েকটি অসঙ্গতিও ছিল।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, কমিশন সরকারকে চিঠি দিয়ে পরামর্শ দিয়েছে যেন আগের খসড়াটির পরিবর্তে সব প্রয়োজনীয় বিষয় সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন স্বাস্থ্য প্রশাসন দুটি পৃথক আইন প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তিনি আরও জানান, মন্ত্রণালয় আজ খসড়া আইনগুলো পর্যালোচনা করার জন্য অংশীজনদের একটি বৈঠক ডেকেছে। আলোচনায় সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা ও পেশাগত সংগঠনের প্রতিনিধি অংশ নেবেন।

স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা অধ্যাদেশ

এই আইনের খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে হামলা, হুমকি ও ভাঙচুরের ঘটনা বাড়ছে।

এই সব ঘটনা স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ব্যাহত করছে, জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপদ কর্মক্ষেত্রের অধিকার লঙ্ঘন করছে।

এই অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য হলো, চিকিৎসা পেশাজীবীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে স্বাস্থ্যসেবা সংরক্ষণ করা।

এই অধ্যাদেশে ধাপে ধাপে শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। যদি কেউ স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর হামলা করে, আঘাত করে বা শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তাহলে তার শাস্তি হতে পারে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তিই হতে পারে।

যদি হামলায় গুরুতর আঘাতের ঘটনা ঘটে, তাহলে শাস্তি বেড়ে হবে সাত বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়ই। স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান বা তার সম্পদ (যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ইত্যাদি) ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ক্ষতি করলে শাস্তি হতে পারে ৭ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা।

জরুরি বা নিয়মিত চিকিৎসা সেবা বাধাগ্রস্ত করা হলে শাস্তি হতে পারে ৩ বছর কারাদণ্ড বা ৩ লাখ টাকা জরিমানা।

মিথ্যা অভিযোগ দাখিল করা বা স্বাস্থ্যকর্মীদের হয়রানি করা হলে শাস্তি হতে পারে ২ বছর কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানা।

খসড়া আইনে আরও বলা হয়েছে, এই অধ্যাদেশের সব অপরাধ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত করতে হবে এবং চার্জশিট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে জমা দিতে হবে।

রোগী সুরক্ষা ও প্রতিকার অধ্যাদেশ

রোগীদের সুরক্ষায় করা এই খসড়া আইনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, এই অধ্যাদেশ দরকার যাতে চিকিৎসায় অপ্রয়োজনীয় ক্ষতি রোধ করা যায়, রোগীর অধিকার রক্ষা করা যায় এবং চিকিৎসার ভুলে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দ্রুত ও সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

এতে বলা হয়েছে, চিকিৎসার কারণে যদি গুরুতর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বা অপ্রত্যাশিত মৃত্যু ঘটে, তা দ্রুত দেখার এবং নথিভুক্ত করার দায়িত্ব নিতে হবে প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে।

গুরুতর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বলতে বোঝায়—ভুল রোগী বা ভুল অঙ্গের অস্ত্রোপচার করা, অস্ত্রোপচারের পর শরীরে কোনো যন্ত্রপাতি থেকে যাওয়া, এমন গুরুতর ওষুধের ভুল যা মৃত্যু বা স্থায়ী ক্ষতি ঘটায়।

তবে, এমন পর্যালোচনা করা মানেই যে কেউ ভুল বা অবহেলার জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনের আওতায় আসবে, তা নয়।

মামলার আগে পক্ষগুলো চাইলে নিজেদের মধ্যে বিকল্প উপায়ে বিরোধ সমাধান করতে পারে। এতে ক্ষতিপূরণ, সংশোধনমূলক ব্যবস্থা বা দুঃখপ্রকাশ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

চিকিৎসায় অবহেলার জন্য ফৌজদারি দায় তখনই হবে, যখন কোনো স্বাস্থ্যকর্মীর আচরণ ইচ্ছাকৃত ক্ষতি, প্রতারণা বা দণ্ডবিধি অনুযায়ী গুরুতর অবহেলা হিসেবে ধরা হবে।

যদি কেউ অনুমোদন ছাড়াই চিকিৎসা সেবা দেয় বা নিজের দায়িত্বের বাইরে কোনো কাজ করে, তাহলে সেটা ইচ্ছাকৃত অবহেলা হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধের শাস্তি হতে পারে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়ই।

মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সরকার চিকিৎসায় অবহেলা ও রোগীর অধিকারে ট্রাইব্যুনাল গঠন করবে। প্রতিটি ট্রাইব্যুনালে জেলা ও দায়রা জজ বা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ চেয়ারম্যান হিসেবে থাকবেন।

এ ছাড়া, দুজন নিরপেক্ষ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও একজন রোগী অধিকার প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে থাকবেন।

রোগী বা ভুক্তভোগী ঘটনা জানার এক বছরের মধ্যে মামলা করতে পারবেন। ট্রাইব্যুনালকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে।

তবে, এই অধ্যাদেশ বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলকে (বিএমডিসি) তাদের দায়িত্বসীমার মধ্যে কোনো পেশাগত ভুল বা অসদাচরণের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার কেড়ে নেবে না।

 

ad

পাঠকের মতামত