371185

বিশ্বজুড়ে বায়ু দূষণ বৃদ্ধি: মানবস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি

কামাল হোসেন।।  বিশ্বের পরিবেশ আজ এক ভয়াবহ সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুতর যে সমস্যাটি বিশ্বব্যাপী মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রাকে হুমকির মুখে ফেলছে, তা হলো বায়ু দূষণ। দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহন বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর অনেক অঞ্চলের বায়ু মান প্রতিনিয়ত অবনতির দিকে যাচ্ছে।

বৈশ্বিক চিত্র

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে বায়ু দূষণের কারণে অকাল মৃত্যুবরণ করছেন। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো শ্বাসযন্ত্রের রোগ, হাঁপানি, ফুসফুসের ক্যান্সার, দীর্ঘস্থায়ী ব্রঙ্কাইটিস এবং হৃদরোগ। নগর এলাকাগুলোতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা (PM2.5 ও PM10), নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড, সালফার ডাই–অক্সাইড, ওজোন এবং কার্বন মনোক্সাইড বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যা মানুষের জন্য অদৃশ্য হলেও সবচেয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।

বাংলাদেশে বায়ু দূষণের ভয়াবহতা

বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায়, বায়ু দূষণ এখন জনস্বাস্থ্য সংকটের পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাপী দূষিত শহরের তালিকায় প্রায়শই শীর্ষে অবস্থান করছে ঢাকা। প্রধান দূষণকারীর মধ্যে রয়েছে—

  • যানবাহনের ধোঁয়া

  • ইটভাটা ও কারখানার বর্জ্য গ্যাস

  • নির্মাণকাজের ধুলাবালি

  • খোলা জায়গায় আবর্জনা ও বর্জ্য পোড়ানো

শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদি বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ার হার বাড়ছে, একই সঙ্গে বৃদ্ধদের মধ্যে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।

স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও সামাজিক প্রভাব

বায়ু দূষণ শুধু স্বাস্থ্য নয়, অর্থনীতিতেও ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী অসুস্থ হয়ে পড়ায় উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি এবং অকালমৃত্যুর কারণে জাতীয় অর্থনীতিতে প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ু দূষণকে শুধু পরিবেশগত সংকট নয়, বরং একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা হিসেবেও বিবেচনা করা জরুরি।

সরকারি পদক্ষেপ ও সীমাবদ্ধতা

বাংলাদেশ সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন—

  • পরিবহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত ফিটনেস চেক

  • শিল্প কারখানার নির্গমন নিয়ন্ত্রণে আইনি ব্যবস্থা

  • ইটভাটা আধুনিকায়নের উদ্যোগ

  • জনসচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি

তবে এসব পদক্ষেপের কার্যকারিতা এখনও সীমিত। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং প্রযুক্তিগত ঘাটতি থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো নবায়নযোগ্য শক্তি, বৈদ্যুতিক যানবাহন এবং সবুজ প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ও হাইড্রোজেন জ্বালানির ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। পরিবেশবান্ধব নগরায়ণ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশও ধীরে ধীরে এই প্রবণতায় অংশ নিচ্ছে, তবে কাঙ্ক্ষিত গতিতে নয়।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন—

  • দূষণ নিয়ন্ত্রণে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য।

  • এককভাবে কোনো দেশ কার্যকর সমাধান দিতে পারবে না।

  • কঠোর আইন প্রণয়ন, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া বায়ু দূষণ কমানো সম্ভব নয়।

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সতর্কবার্তা

পরিবেশ রক্ষায় অবিলম্বে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পৃথিবী আরও বসবাস-অযোগ্য হয়ে উঠবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বায়ু দূষণের প্রভাব বাড়তে থাকলে খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও অর্থনীতি—সবই ভয়াবহ চাপে পড়বে।

উপসংহার:
বায়ু দূষণ এখন আর কোনো এক দেশের সমস্যা নয়, বরং বৈশ্বিক সংকট। তাই টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেরি হলে এর মূল্য দিতে হবে মানবসভ্যতাকেই।

ad

পাঠকের মতামত