পশুর হাটে যেভাবে চিনবেন ওষুধ খাওয়ানো এবং অসুস্থ গরু
আমরা বাঙালী মাত্রই হুজুগে জাতি। কোনো কিছু নতুন আসলেই আমাদের সেটা নিয়ে মেতে উঠতে হবে। পাশের বাসার অমুক ভাই এই জিনিসটা কিনছেন, তাহলে আমারও সেটা কিনতে হবে।
তমুক ফ্ল্যাটের সমুক ভাবী এক লাখ টাকার শপিং করেছেন ইন্ডিয়া থেকে, আমাকেও সেটা কিনতে হবেই। নিজেদেরকে বড় দেখানোর সুযোগ পেলে আমরা কিছুতেই ছাড়িনা। হোক সেটা তুচ্ছ কোনো জিনিস বা বিরাট কোনো বিষয়। এজন্যই আমাদের দেশে যেসব পণ্য পাওয়া যায় তাতে গুণগত মানের চেয়ে চটকদার প্রচারণাতেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
রমজানের ঈদে সব সংযম ভুলে আমরা প্রতিযোগিতা করি কে কত বেশি দামের জামা কিনতে পারব। আর কুরবানির ঈদে ত্যাগের মহিমা বাদ দিয়ে আমরা মেতে উঠি কে কত বড় প্রাণী কুরবানি দেব। এসবের ফায়দা নিয়ে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী আরম্ভ করেছে কুরবানির পশুকে নিয়ে ব্যাবসা। প্রশাসন দেরিতে হলেও পদক্ষেপ নিয়েছে, কিন্তু তা সত্যিই অপ্রতুল। আর এই ব্যার্থতার পিছনে একমাত্র কারণ হচ্ছে আমাদেরই অন্যায় চাহিদা।
কয়েকবছর ধরে টিভি, পত্র-পত্রিকায় গরু মোটাতাজাকরন আর এর প্রভাবের উপর অনেক লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু তাও কি আমরা এর সম্পর্কে সচেতন হচ্ছি? বাজারে গিয়ে আমাদের চোখ কি বড়-চকচকে গরুটার দিকে যায়না?
তাই আজকে আমার এই লেখা আপনাদেরকে মোটাতাজাকরনের প্রভাব, কুরবানির সুস্থ এবং অসুস্থ গরু চেনার উপায়, বাজারে ব্যবসায়ীরা কি কি অসাধু কাজ করে এবং বাজারে সঠিক মাংস চেনার উপায় নিয়ে।
গরু মোটাতাজাকরনঃ
আপনি যদি চান, তবে ভালো জাতের প্রাণীকে সুষম খাবার, নিয়মিত কৃমিনাশক, ভিটামিন-মিনারেলস এবং সর্বোপরি সঠিক ম্যানেজমেন্ট দিলেই তার অন্য গরুর চেয়ে কম সময়ে ওজন বাড়বে এবং এটা সম্পূর্ণ বিজ্ঞান সম্মত। কিন্তু আমরা সেটা করব না, আমরা প্রাণীকে একমাসের মধ্যে মোটা বানাব, বানিয়ে টাকা কামাব। অতদিন অপেক্ষা করার সময় আছে নাকি আমাদের?
এখন আপনাদের বলছি প্রাণীকে কম খরচে অল্প সময়ে মোটা বানানোর ওষুধ খাওয়ানোর ফল কি হতে পারে। এসব কাজে ব্যাবহার করা হয় স্টেরয়েড টাইপের ড্রাগ। ২০১০ সালে প্রেসক্রিপশন ছাড়া স্টেরয়েড ড্রাগ বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও সেগুলো পাচার হয় ইন্ডিয়া থেকে। বাজারে এরা ভিটামিন ট্যাবলেট হিসেবে আসে। স্বল্পশিক্ষিত ফার্মেসিওয়ালারা এসব ড্রাগ না জেনেই বিক্রি করে থাকেন কিছু কমিশনের আশায়।
কোরবানি সিজন এবং আমাদের নিজেদের সেরা দেখানোর হুজুগ
স্টেরয়েড প্রয়োগ করে অল্প সময়ে মোটা করা একটি গরুর নমুনা
এই ড্রাগ প্রাণীর শরীরে গিয়ে যেসব মুল প্রভাব ফেলে তা হলঃ
বিপাকক্রিয়ার হার বাড়িয়ে দিবে এবং এতে শরীর প্রোটিন ও লিপিড ব্যবহার করে শক্তি বানাতে চাইবে।
কিডনির নেফ্রনের স্টেরয়েড রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয় এবং শরীর থেকে পানি বের হতে দেয়না। এই অতিরিক্ত দূষিত বর্জ্যযুক্ত পানি শরীরের বিভিন্ন কোষে জমা হয়ে গরুর শরীরকে অস্বাভাবিক মোটা দেখায়।
প্রাণীর শরীরের গ্লুকোজ সমতা কমে গিয়ে ডায়াবেটিস হবে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে।
আক্রান্ত গরুর মাংস খেলে আপনার শরীরে কি প্রভাব ফেলবেঃ
কিডনিতে সমস্যা দেখা দিবে।
ডায়াবেটিস রোগিরা অতিমাত্রায় এমন প্রানীর মাংস খেলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পরবেন।
চোখে গ্লুকোমা হতে পারে।
প্রজননক্ষমতা কমে যাবে।
অতিরিক্ত স্টেরয়েড মাংসপেশি আর হাড়ের ক্ষয় করতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরে এমন মাংস খেলে আপনার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে।
অসুস্থ গরু চেনার উপায়ঃ
শরীর হবে থলথলে,উরুতে অতিরিক্ত মাংস থাকবে।
গরু চলাফেরা কম করতে চাইবে।
পুরো শরীরে পানি জমে মোটা দেখাবে, চাপ দিলে সহজে গর্ত হয়ে যাবে।
পাঁজরের হাড় যেখানে শেষ হয়েছে সেখানের একটু গর্ত জায়গাটুকুও অতিরিক্ত ভরাট মনে হবে।
গরু যে হারে মোটা হবে তার দ্বিগুণ হারে ওজন কমবে।
অসুস্থ গরুর মাংস চেনার উপায়ঃ
মাংসের রঙ স্বাভাবিক হবেনা।
প্রাণীকে কাটলে শরীরের মধ্যে পানি জমে থাকতে পারে।
কলিজার রঙ সবখানে একইরকম লালচে হবেনা।
নাড়িভুঁড়ি গুলোতে কালচে দাগ থাকতে পারে।
চামড়া ছাড়ানোর সময় সহজে ছাড়ানো যাবেনা।
মাংসে কালচে দাগ থাকতে পারে।
স্টেরয়েড খাওয়ানো প্রাণীর শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রস্রাবের দূষিত পদার্থ জমা হয়ে মাংস থেকে প্রস্রাবের গন্ধ আসবে।
লিভারে ছোট ছোট অসংখ্য ছিদ্র থাকবে (কলিজাকৃমি)।
ফুসফুসে অসংখ্য ছোট ছোট গোটা থাকবে (টিবি আক্রান্ত)।
কুরবানির জন্য সুস্থ গরু চেনার উপায়ঃ
মাঝারি বয়স (৩-৪ বছর) হতে হবে।
গরুর বয়স জানার উপায়ঃ ১৯-২৪ মাস গরুতে সামনে দুইটা স্থায়ী ইনসিসর দাঁত উঠবে।
তাছাড়া শিং এ মোট রিং এর সাথে ২ যোগ করলে বয়স জানা যায়।
গর্ভবতী যেন না হয়।
সাধারণ চলাফেরা করবে।
মুখের কালো অংশটা (মাজল) ভেজা এবং চকচকে হবে।
গরু অন্ধ কিনা দেখার জন্য চোখের সামনে আঙ্গুল নাড়াতে হবে এবং পারলে গরুকে একটু হাঁটিয়ে দেখতে হবে।
চামড়া মোটামুটি ঢিলেঢালা হবে।
বুক প্রশস্ত আর বিস্তৃত। কোমরের দুই পাশ পুরু আর প্রশস্ত।
কাঁধ পুরু আর মসৃণ এবং পিঠটা সমতল হবে।
শরীরের হাঁড়ের আকার মোটা হবে।
বুক প্রশস্ত আর বিস্তৃত হতে হবে।
পিঠ চ্যাপ্টা আর সমতল হবে।
শরীরের লোম পরিষ্কার থাকবে এবং ঘা থাকবেনা, অতিরিক্ত লোম উস্কু-খুস্কু থাকা উকুন বা আঠালির লক্ষণ।
চোখের নিচের অংশটা টেনে রক্তশুন্যতা আছে কিনা দেখা যায়।(মানুষে যেভাবে দেখে)
গরুর পায়ে কোনো ঘা থাকবেনা এবং পাগুলো ধনুকের মত বাঁকানো হবেনা।
এসব দেখে গরু চেনা যাবে এবং অন্য প্রানী (ছাগল, ভেড়া) কেনার সময়ও এভাবে পরীক্ষা করা যাবে।
কুরবানির গরু নিয়ে আসার পর যত্নঃ (১০০ কেজি ওজনের গরুর জন্য)
ঘাস ৪-৫ কেজি।
ইউরিয়া মোলাসেস মিশ্রিত খড় ২ কেজি।
দানাদার খাবার/ কুড়া/ ভুষি ২.৫ কেজি।
পরিমাণমত পানি।
লবন ১ কেজি দানাদার খাবারে ১০০ গ্রাম।
ভিটামিন প্রিমিক্স।
প্রাণী বিক্রির সময় বিক্রেতারা যেসব অসাধু কাজ করে থাকেনঃ
বয়স্ক গরুকে চামড়া টানটান দেখানোর জন্য চামড়ার নিচে বাতাস ঢুকিয়ে দেয়া হয়।
গরুর দাঁত ক্ষয়ে গেলে তাতে কালো রঙ করে কোনো ঘাস জাতিয় জিনিস ঢুকিয়ে দেয়া হয়, যাতে ক্রেতা গরুর বয়স কিংবা দাঁতের সমস্যা বুঝতে না পারে।
গরুর গায়ে কোনো ঘাঁ থাকলে সেখানে কাদা-ধুলা মেখে দেওয়া হয়।
গরুর সামনের পা একটু খোঁড়া থাকলে পিছনের পাও ইচ্ছা করে হাল্কা খোঁড়া করে দেয়া হয় যেন বোঝা না যায়।
মাংস বিক্রির সময় বিক্রেতারা যেসব অসাধু কাজ করে থাকেনঃ
গরুর মাংস বলে মহিষের মাংস বিক্রি।
ছাগলের মাংস বলে ভেড়ার মাংস বিক্রি।
বাসি বা অনেক আগে কাটা মাংসের উপর টাটকা রক্ত ছিটিয়ে দেওয়া।
মাংসের গায়ের চর্বিটাকে টাটকা দেখানোর জন্য হাল্কা হলুদের গুড়ো লাগিয়ে দেওয়া।
মাংসকে টাটকা দেখানোর জন্য তার গায়ে ফরমালিন যুক্ত পানি ছিটিয়ে দেওয়া।
অসুস্থ প্রাণীর মাংসকে সুস্থ প্রাণীর মাংসের সাথে মিশিয়ে বিক্রি করা।
কোন মাংসটি কোন প্রাণীর?
গরু আর মহিষ
গরুর মাংসের রঙ মহিষের মাংসের চেয়ে সামান্য কম লাল হয়।
গরুর মাংসে ফ্যাট এর মারবেলিং থাকে।
মহিষের মাংস তন্তুগুলো বেশি চিকন আর শক্ত হয়।
আমরা অনেকেই মহিষের মাংস খেতে চাইনা, তাই ব্যবসায়ীরা গরুর মাংসের চাহিদার জন্য এমন অসাধুতা করে। কিন্তু স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে মহিষের মাংসে গরুর মাংসের চেয়ে চর্বি কম থাকায় মহিষের মাংস খাওয়া বেশি ভাল।
খাসি আর ভেড়ার মাংস
প্রথমেই বলে নিই,ভেড়ার মাংসের আসল ইংরেজি নাম হল মাটন আর খাসির মাংসের নাম হল চেভন। আমরা এটা প্রায় ভুল করি।
ভেড়ার মাংসের রঙ একটু বেশি লাল হয় খাসির চেয়ে।
ছাগলের মাংসে ফ্যাটগুলো মারক করা থাকে
খাসির মাংসে একটু গন্ধ থাকে (ক্যাপ্রোয়িক গন্ধ)।
আজকে এতটুকুই, আমার লেখা যে উদ্দ্যেশ্যে লেখা সে মোতাবেক যদি আপনারা এই ঈদে কুরবানির পশু কিনে থাকেন এবং ভবিষ্যতে বাজার থেকে মাংস কিনার সময় সচেতন থাকেন তবেই আমি সার্থক। তাও কোনো সমস্যা হলে আপনার নিকিটস্থ ভেটেরিনারিয়ানকে জানান এবং অতি অবশ্যই কুরবানি করার পরে আপনার চারপাশ পরিষ্কার রাখবেন।