372047

তিন আগুনের পর ‘নাশকতার অভিযোগ, সন্দেহ আর অবিশ্বাস’ আলোচনায়

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। বাংলাদেশে ঢাকা ও চট্টগ্রামে হুট করে তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেশে নানা ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই এসব ঘটনাকে ‘নিছক দুর্ঘটনা’ বলে মেনে নিতে রাজি নন।

ঢাকায় বিমানবন্দরে ভয়াবহ আগুনের ঘটনার পর সরকারের বিবৃতিতেই ‘নাশকতা’, ‘জনমনে আতঙ্ক’ কিংবা ‘বিভাজন সৃষ্টির’ মতো শব্দগুলোর ব্যবহার অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারগুলোর সময়ে সবসময়ই বড় কোনো ঘটনা ঘটলেই বিরোধী পক্ষকে হেনস্থা করতে সরকারের দিক থেকে এ ধরনের শব্দ ব্যবহারের চর্চা দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে।

এমনকি এ ধরনের ঘটনার জের ধরে বিরোধীদের দমন পীড়নের উদাহরণও বাংলাদেশে আছে। আর এমন সংস্কৃতির কারণে বেশিরভাগ ঘটনার সত্যিকার কারণ কখনো উদঘাটিত হয়নি-এমন অভিযোগও পুরনো।

আবার বড় ধরনের ঘটনা ঘটলে কিছু গোষ্ঠী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাকে অভিযুক্ত করে প্রচার চালানোর প্রবণতাও পুরনো।

বাংলাদেশে গত কিছুদিন ধরেই একটি বড় আলোচনা হচ্ছে ‘নির্বাচন ঘোষিত সময়ে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতেই’ হবে কি না। এখন তিনটি বড় দুর্ঘটনার পর সেই আলোচনা আরও জোরদার হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।

তবে বিশ্লেষকদের মতে, ঘটনাগুলো বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সংস্কৃতি নেই বলেই দুর্ঘটনা ঘটলেই ‘নাশকতার অভিযোগ আর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ জোরদার হয়ে ওঠে।

এবারের যত আলোচনা
ঢাকায় বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে শনিবার। এর আগে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম ইপিজেডে একটি কারখানা আগুনে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। তারও আগে গত মঙ্গলবার মিরপুরে রাসায়নিক গুদাম ও একটি পোশাক কারখানায় আগুনের ঘটনায় ১৬ জন প্রাণ হারায়।

বিমানবন্দরে আগুনের ঘটনার পর সরকারের দিক থেকে দেয়া বিবৃতি আলোচনায় এসেছে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে “নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা উসকানির মাধ্যমে জনজীবন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করার সুযোগ দেওয়া হবে না”।

অনেকের ধারণা সরকার মূলত আওয়ামী লীগের দিকে ইঙ্গিত করেই তদন্তের আগেই এমন বক্তব্য দিয়েছে।

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থককেও সামাজিক মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে এসব দুর্ঘটনার জন্য সরকারের দিকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে বিমানবন্দরে আগুনের পর ‘বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনায় বিদেশি কোম্পানিকে আনার জন্য’ এসব করা হচ্ছে- এমন অভিযোগও করছেন কেউ কেউ।

বিমানবন্দরের আগুনের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শনিবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, “সম্প্রতি দেশে কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এবং আজ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনে আগুন লাগার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত বলে জনগণ বিশ্বাস করে”।

তার মতে, “ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে এবং দেশকে অস্থিতিশীল করতেই ফ্যাসিস্টদের দোসর’রা জোরালোভাবে নানা ধরনের সহিংস কর্মকাণ্ড শুরু করেছে”।

অর্থাৎ তিনি এসব ঘটনার জন্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।

এনসিপির অন্যতম নেতা সারজিস আলম তার বিবৃতিতে বলেছেন, “বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখিনা। এগুলো স্বৈরাচারের দোসরদের দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তের অংশ। তথাকথিত তদন্ত কমিটির নাটক বাদ দিয়ে এর পিছনের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা হোক”।

আবার সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি সংঘটিত একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জনমনে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার তা গভীরভাবে অবগত।

“আমরা সকল নাগরিককে আশ্বস্ত করতে চাই—নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রতিটি ঘটনা গভীরভাবে তদন্ত করছে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে। নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা উসকানির মাধ্যমে জনজীবন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করার সুযোগ দেওয়া হবে না”।

এতে আরও বলা হয়, “আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই—যদি এসব অগ্নিকাণ্ড নাশকতা হিসেবে প্রমাণিত হয় এবং এর উদ্দেশ্য হয় জনমনে আতঙ্ক বা বিভাজন সৃষ্টি করা, তবে তারা সফল হবে কেবল তখনই, যখন আমরা ভয়কে আমাদের বিবেচনা ও দৃঢ়তার ওপর প্রাধান্য দিতে দেব। বাংলাদেশ অতীতেও বহু কঠিন সময় অতিক্রম করেছে। আমরা ঐক্য, সংযম ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে আমাদের গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে যেকোনো হুমকির মোকাবিলা করব। আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই”।

এর বিপরীতে পাল্টা প্রচার চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও। তাদের কেউ বলছেন ‘নির্বাচন না করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে’।

তবে আগুনের তিনটি ঘটনাতেই তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। মিরপুরে রাসায়নিক গুদাম থেকে এবং চট্টগ্রামে আটতলার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে আগুন লেগেছে বলে ধারণা করলেও সূত্রপাত কীভাবে হয়েছিল, এখনো জানায়নি ফায়ার সার্ভিস।

আলোচনায় অদৃশ্য শক্তি
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, চকবাজারের বা বেইলি রোডের আগুনের সময় গোয়েন্দা সংস্থা করেছে বা কোনো এজেন্টরা করেছে এমন আলোচনা আসেনি।

“কিন্তু এখন যেভাবে হচ্ছে তার পেছনে নাশকতার সম্ভাবনার কথা শুনছি। এখন এক দল বলবে সরকার নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার জন্য এগুলো করছে, কারণ এগুলো কারণে পরিস্থিতি প্রতিকূল হলে তো নির্বাচন হবে না। আরেকদল বলবে পরাজিত শক্তি ফিরে আসার জন্য যে ফন্দি ফিকির করছে, এগুলো তার অংশ,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

তার মতে, দুর্ঘটনা ঘটলে সেগুলোর যথাযথ তদন্ত হয় না বলেই নাশকতার অভিযোগ তুলে ব্যর্থতার দায় এড়ানোর চেষ্টা হয় কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো মতলব খোঁজার সুযোগ পায়।

আরেকজন বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলছেন, জাতির মধ্যে নিরাপত্তাবোধ তৈরি হয়নি কারণ কিছু ঘটলে তার কারণ খতিয়ে দেখার মতো বড় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে গড়ে তোলা হয়নি।

“দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র থাকতেও পারে। কিন্তু সরকার বা রাষ্ট্রের মধ্যে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ কই। সেটি নেই বলেই ব্যর্থতা ঢাকার জন্য কখনো বিরোধী দল কিংবা কখনো অন্যদেশের গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করতে হয়। ফলে পাল্টা অভিযোগ আসে সরকারের বিরুদ্ধেও,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীনতার পর দেশে অনেক খাদ্য গুদামে ও পাটকলে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিলো। তখন থেকেই এসব ঘটনার জন্য দেশি-বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার দিকে ইঙ্গিত করার একটি প্রবণতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সবসময়ই দেখা গেছে।

যদিও এর কোনো প্রমাণ কেউ উপস্থাপন করেননি।

এমনকি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বড় ঘটনা বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার জন্যও একটি পক্ষ বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার নাম প্রচার করে থাকেন। যদিও বর্তমান সেনা প্রধান নিজেও বলেছেন যে এটি বিডিআর সদস্যদেরই কাজ ছিলো।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, “একটা জিনিস আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, এই বর্বরতা কোনো সেনাসদস্য করেনি। সম্পূর্ণটাই তদানীন্তন বিজিবি (বিডিআর) সদস্য দ্বারা সংঘটিত। ফুলস্টপ। এখানে কোনো “ইফ” এবং “বাট” (যদি ও কিন্তু) নাই”।

আবার অনেক ঘটনার পর দেখা গেছে এমন প্রচার হচ্ছে যে- বিরোধী দল বা পক্ষকে বিপাকে ফেলতে গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে সরকারই এটি করেছে। যদিও এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।

এমনকি কেউ আনুষ্ঠানিকভাবেও এসব অভিযোগ করে না কিংবা কোনো তথ্য প্রমাণও কেউ প্রকাশ করেনা।

কিন্তু কাছাকাছি সময়ে কয়েকটি বড় ধরনের আগুন লাগার মতো ঘটনা কতটা স্বাভাবিক?

জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক মিজানুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ”আগুন নেভানোর জন্য কোনো সময় বা মৌসুম লাগে না। শুষ্ক আবহাওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ঠিক, কিন্তু বাংলাদেশের অনেক আগুনের ঘটনাতেও শুধু আবহাওয়া নয়, সেখানে সতর্কতার অভাব,আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা বা যথাযথ ব্যবস্থা না থাকা, দাহ্য পদার্থ থাকার কারণেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ”

ঢাকায় কয়েকটি বড় আগুনের ঘটনায় তদন্তকারী দলের সদস্য ছিলেন মি. রহমান। সেই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলছেন, ”অনেক স্থানে ফায়ার সেফটি থাকে না, লোকজনের কর্তব্যে অবহেলা থাকে, যথাযথ ফায়ার ফাইটার টিম থাকে না। ফলে কোথাও ছোটখাট আগুন লাগলেও সেটা দ্রুত বড় হয়ে যায়। কোথাও আগুন লেগে গেলে সেটা সহজে ছড়িয়ে পড়ে।”

বড় বড় আগুনের ঘটনা ঘটলেই এ নিয়ে নানা কথা হয়, কিন্তু সেসব ঘটনা থেকে বাস্তবে খুব বেশি পরিবর্তন হয় না তিনি মন্তব্য করেন।

 

ad

পাঠকের মতামত