
জুলাই সনদ জনজীবনে কতটা পরিবর্তন আনবে?
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের মাধ্যমে ‘নতুন বাংলাদেশের সূচনা করলাম’ বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু এই জুলাই সনদ সাধারণ মানুষের জীবনে কতটা পরিবর্তন আনতে পারবে, সেই প্রশ্ন সামনে আসছে।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্দেশে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রায় আট মাস ধরে কয়েক ধাপে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ধারাবাহিক বৈঠকের পর চূড়ান্ত করে জুলাই জাতীয় সনদ। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) সেই সনদে স্বাক্ষর করেছে রাজনৈতিক দলগুলো।
এই সনদে সংবিধান, নির্বাচন ও বিচার ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমনসহ বেশ কিছু সংস্কারের সুপারিশমালা রয়েছে। তবে দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর যে জুলাই সনদ চূড়ান্ত হয়েছে সেখানে শ্রমিক অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, নারীর অধিকার নিয়ে তেমন কিছুই নেই বলে মনে করছেন অনেকেই।
স্বাভাবিকভাবে জুলাই সনদ নিয়ে মানুষের মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা অনেকাংশেই পূরণ হয়নি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা কিংবা অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়গুলো প্রত্যক্ষভাবে আনার সুযোগ থাকলেও সেগুলো এই সনদে নেই। যে কারণে জুলাই সনদ ঘিরে একেবারের প্রান্তিক ও সাধারণ মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, তার অনেকাংশেই পূরণ হয়নি বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।
অবশ্য ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, কয়েকটি সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা শুরুর পর আরো কয়েকটি সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট জমা হয়েছে। যে কারণে নতুন করে ওই সংস্কার কমিশনগুলোর নিয়ে আলোচনা করা যায়নি।
তিনি মনে করেন, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার অন্য কমিশনগুলোর রিপোর্টের ভিত্তিতেই সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারেন।
সনদে উপেক্ষিত স্বাস্থ্য খাত
দায়িত্ব নিয়েই অন্তর্বর্তী সরকার যে সব সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল তার একটি ছিল স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন।
জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের কমিশন গত ৫ই মে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনাকে আরও জনবান্ধব করতে ব্যাপক সংস্কারের সুপারিশ করে।
এক্ষেত্রে বিদ্যমান স্বাস্থ্য আইন সংস্কার, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্নের জন্য সার্ভিস সেন্টার স্থাপন, শহুরে জনগোষ্ঠীর জন্য ওয়ার্ডভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু, স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় সৃজনশীলভাবে হেলথ এডুকেশন চালুর মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্যসচেতনভাবে গড়ে তোলাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল।
স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছিল।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে নানা সংকট রয়েই গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার এই কমিশন গঠনের পর ধারণা করা হচ্ছিল এই সংস্কার প্রস্তাবের কিছু অংশ জুলাই সনদে স্থান পাবে। কিন্তু সেটি হয়নি।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের মতো যারা স্বল্প আয়ের মানুষ আছে, তাদের জন্য সুচিকিৎসা পাওয়া একটা বিলাসিতা। সরকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সংস্কারে কমিশন গঠন করার পর আমরা আশা করেছিলাম স্বাস্থ্য খাতে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু এখনো এমন কিছু আমরা দেখি নাই। জুলাই সনদেও তার কিছুই পাইনি।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, দেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে একটা বড় সংকট রয়ে গেছে। এ নিয়ে সংস্কার কমিশন গঠন করা হলেও সেই কমিশনের কোনো সুপারিশ জুলাই সনদে না থাকাটা হতাশাজনক। স্বাস্থ্য একটা বড় সেক্টর ছিল। যেখানে কিছুই করলো না। অথচ এটা কত গুরুত্বপূর্ণ একটা সেক্টর ছিল এটা।
অর্থনৈতিক সংকট কীভাবে কাটবে?
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা প্রায় ১৭ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ ছিল দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। বিদেশে অর্থ পাচার, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, লুটপাট কিংবা পাচারের মতো ঘটনা ছিল সংবাদ মাধ্যমের নিয়মিত খবর।
যে কারণে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই দেশের অর্থনৈতিক খাতের দুর্নীতির মূলোৎপাটনে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে।
ওই কমিটি দেশের অর্থ খাতের পাচার ও দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাটসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ে তাদের প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র তৈরি করে। এই কমিটি অর্থনৈতিক খাতের এই সংকট কাটাতে বেশ কিছু সুপারিশও জমা দিয়েছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে।
গত প্রায় আট মাস ধরে ধারাবাহিক আলোচনার পর ঐকমত্য কমিশন যে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করেছে সেখানে সরকারি-বেসরকারি খাতের দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বন্ধে বেশ কিছু দফা যুক্ত করেছে। একই সাথে দুর্নীতিবিরোধী কৌশলপত্র প্রণয়নের কথাও বলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইডি গবেষক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী কারিমুজ্জামান বলেন, জুলাই সনদে অর্থনৈতিক সংস্কার বিষয়ক তেমন কোনো পলিসি গুরুত্ব পায়নি। এটি এই সনদের একটি বড় দুর্বলতা এবং এটি খুবই হতাশাজনক।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জুলাই সনদে আর্থিক দুর্নীতি বন্ধে নানা সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু আর্থিক খাত সংস্কারে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবনা রাখা হয়নি।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সই হওয়া জুলাই সনদে অপ্রত্যক্ষভাবে অর্থ খাতের দুর্নীতি বন্ধের কিছু সুপারিশ আছে। তবে কিছু কিছু জিনিস প্রত্যক্ষভাবে আনার সুযোগ ছিল। কিন্তু কমিশন এটা করেনি। এটাই একটা দুর্বলতা।
শিক্ষা নিয়ে নেই কোনো সুপারিশ
সরকারি চাকরিতে কোটা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল ২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন। সেই আন্দোলন পরে এক দফার আন্দোলনে রূপ নিলে পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের।
বিগত সরকারের আমলে শিক্ষা খাতে চরম বৈষম্য ও সংকট নিয়ে গণমাধ্যমে নানা খবর প্রচারিত হতেও দেখা গেছে।
শিক্ষা খাতের নানা সংকট নিয়ে বছরের পর বছর ধরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের রাস্তায় আন্দোলন চালাতেও দেখা যায়। দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। কিন্তু শিক্ষা খাত সংস্কারে সরকার কোনো কমিশন গঠন করেনি।
যে কারণে এই বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমেও নানা ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে সংকট ও বৈষম্য দূর করতে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর শিক্ষা কমিশনের গঠনের পরামর্শ ছিল শিক্ষাবিদদের।
গত শুক্রবার যে জুলাই সনদে রাজনৈতিক দল ও অন্তর্বর্তী সরকার স্বাক্ষর করেছে সেখানেও শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কারে তেমন কোনো সুপারিশ দেখা যায়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রাপ্তি তাপসী বলেন, যেই আকাঙ্ক্ষা থেকে জুলাইয়ের আন্দোলন হলো সেখানে আমাদের শিক্ষাখাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীরা জুলাই সনদে সেই আকাঙ্ক্ষার কোনো প্রতিফলন পায় নাই।
এই প্রশ্নে ঐকমত্য কমিশন বলছে, শিক্ষা নিয়ে কোনো কমিশনই গঠন হয়নি। অন্যদিকে সরকার যে কমিশনগুলো গঠন করেছে তার সবগুলো কমিশনের সুপারিশও যুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদের বাইরেও অনেক বিষয়ে সংস্কার করতে হবে। ফলে আমাদেরকে মনে রাখতে হবে সংস্কারের প্রক্রিয়া একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। সামনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সামনেও অনেক কিছু সংস্কারের সুযোগ থাকবে।
নারী ও শ্রমিক অধিকারের কী হবে?
সরকার নারী অধিকার ও শ্রম খাত সংস্কারে আলাদা কমিশন গঠন করেছিল। ওই দুইটি সংস্কার কমিশন এ নিয়ে রিপোর্টও জমা দিয়েছিল অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে।
কিন্তু নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন কিংবা শ্রম খাত সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ দিয়েছে তার কিছুই যুক্ত হয়নি জুলাই সনদে।
শ্রমিকদের অধিকারের প্রসঙ্গ তুলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই যে ধরুন গত সপ্তাহে মিরপুরে আগুনে কতগুলো মানুষ মারা গেলো। এখন যদি শ্রম খাত সংক্রান্ত সুপারিশগুলো যদি সনদে উল্লেখ থাকতো তাহলে হয়তো ওই শ্রমিকরা হয়তো একটা আর্থিক সুরক্ষা সেখান থেকে পেতো।
বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলনে যেমন ছাত্রদের পাশাপাশি শ্রমিকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সেই সাথে ছিল নারীদের ভূমিকাও।
শ্রম খাত সংস্কার কমিশনের মতো নারী সংস্কার কমিশনও নারীদের অধিকার ও সুরক্ষায় নানা সুপারিশ করেছিল। সে সব প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছিল সরকারের কাছে। কিন্তু জুলাই সনদে তার ছিটো-ফোটাও যুক্ত করা হয়নি।
শিক্ষার্থী প্রাপ্তি তাপসী বলেন, সংসদে নারী আসন নিয়ে নারীদের যে চাওয়া বা প্রত্যাশা ছিল তার কিছুই আমরা সনদে দেখি নাই। একইভাবে পাহাড়ি কিংবা প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের চাহিদারও প্রতিফলন দেখা যায়নি এই সনদে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই সনদে এমন কিছু যুক্ত করা প্রয়োজন ছিল যা সাধারণ মানুষের চাহিদাকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু সেটি তুলনামূলক কম হয়েছে বলেও তারা মনে করেন।
আইনজীবী জাহেদ ইকবাল বলেন, এই জুলাই সনদে যতখানি সংবিধান আর রাষ্ট্রীয় সংস্কারের বিষয়গুলো গুরুত্ব পেলেও সাধারণ- প্রান্তিক কিংবা নারীদের আকাঙ্ক্ষার কিছুই প্রতিফলিত হয়নি। সেই সাথে তৃণমূলের মানুষের কথাও এই সনদে তেমনিভাবে আসেনি।