
স্বর্ণের রেকর্ডমূল্যে লাভবান ইতালি: কোন দেশের কাছে কত স্বর্ণ মজুদ আছে?
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের রেকর্ডমূল্যের জোয়ারে অপ্রত্যাশিতভাবে আর্থিকভাবে বেশ লাভবনা হয়েছে ইতালি। দীর্ঘদিন ধরে না বিক্রি করে রিজার্ভ ধরে রাখার কৌশল এখন দেশটির জন্য সত্যিকার অর্থেই ‘স্বর্ণের খনি’ হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের হিসাব অনুযায়ী, ইতালির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২ হাজার ৪৫২ মেট্রিক টন স্বর্ণ মজুত রেখেছে। এই স্বর্ণের বাজারমূল্য প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার। যা দেশটির ২০২৪ সালের জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ১৩ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির পর এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সরকারি স্বর্ণের রিজার্ভ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর তথ্য অনুসারে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণের মজুত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। মজুতের পরিমাণ ৮,১৩৩.৪৬ টন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩,৩৫১.৪৮ টন রয়েছে জার্মানির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। এছাড়া ফ্রান্সের ২,৪৩৭ টন, চীন ২,২৯২ টন, সুইজারল্যান্ড ১,০৪০ টন, ভারত ৮৭৯ টন এবং জাপানের রয়েছে ৮৪৬ টন।
স্বর্ণের সঙ্গে ইতালির সম্পর্ক বহু পুরোনো। ইত্রুসকান যুগ থেকেই দেশটিতে স্বর্ণ গলানো ও অলংকার তৈরির ইতিহাস রয়েছে। রোমান যুগে জুলিয়াস সিজারের সময়কার ‘অরিয়ুস’ মুদ্রা ছিল সাম্রাজ্যের আর্থিক ভিত্তি।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী ও ইতালির নিজস্ব ফ্যাসিস্ট সরকার মিলে দেশটির প্রায় ১২০ টন স্বর্ণ লুণ্ঠন করেছিল। যুদ্ধশেষে হাতে ছিল মাত্র ২০ টন।
তবে যুদ্ধ-পরবর্তী ‘অর্থনৈতিক মিরাকল’ পর্বে রফতানি ও ডলার আয়ের জোয়ারে ইতালি দ্রুত স্বর্ণ ফেরত আনে। ১৯৫৮ সালে হারানো তিন-চতুর্থাংশ স্বর্ণ পুনরুদ্ধার করে এবং ১৯৬০ সালের মধ্যে রিজার্ভ পৌঁছে যায় ১ হাজার ৪০০ টনে।
৭০-এর দশকের তেলের সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় অন্যান্য পশ্চিমা দেশের মতো ইতালিও নিরাপদ সম্পদ হিসেবে স্বর্ণ কেনায় ঝুঁকে পড়ে।
মিলানের বোকোনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্তেফানো কাসেলি বলেন, চরম অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় স্বর্ণ ছিল আর্থিক স্থিতির চূড়ান্ত প্রতীক।
১৯৭৬ সালে বাজেট ঘাটতি মেটাতে জার্মান বুন্দেসব্যাংকের কাছ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে রোম ৪১ হাজার ৩০০টি স্বর্ণের বার বন্ধক রেখেছিল।
তবে ব্রিটেন বা স্পেনের মতো ইতালি কখনোই অর্থনৈতিক মন্দায় স্বর্ণ বিক্রি করেনি। ২০০৮ সালের ঋণ সংকটেও তা ধরে রেখেছিল।
ইতালির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক উপ-গভর্নর সালভাতোরে রসি ২০১৮ সালে তার বই ‘ওরো’ (স্বর্ণ)-তে লিখেছিলেন, স্বর্ণ হলো পরিবারের রূপার বাসন, দাদার ঘড়ির মতো অমূল্য। যখন আন্তর্জাতিক আস্থা টলে যায় তখন এটি শেষ ভরসা।
বর্তমানে ব্যাংক অব ইতালির ভল্টে রয়েছে ৮ লাখ ৭১ হাজার ৭১৩টি স্বর্ণ মুদ্রা, এগুলোর ওজন প্রায় ৪.১ টন। রাজধানী রোমের প্যালাজো কখ ভবনের নিচে প্রায় ১ হাজার ১০০ টন স্বর্ণ রাখা আছে। বাকি স্বর্ণ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ডে সংরক্ষিত।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে ইতালির ৭৫ শতাংশ সরকারি রিজার্ভই ছিল স্বর্ণ, যা ইউরোজোনের গড় ৬৬.৫ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি।
অধ্যাপক কাসেলি বলেন, ব্যাংক অব ইতালির ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত এখন আরও আধুনিক মনে হয়, কারণ বিশ্ব আবার সেই নিরাপদ সম্পদের যুগে ফিরছে।
ইতালির সরকারি ঋণ বর্তমানে ৩ ট্রিলিয়ন ইউরোর বেশি। যা আগামী বছর জিডিপির ১৩৭ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। এ কারণে সময় সময়ে স্বর্ণের রিজার্ভ বিক্রির দাবি উঠলেও ব্যাংক অব ইতালি এখনও কোনও আগ্রহ দেখায়নি।
বাজার বিশ্লেষক জিয়াকোমো কিওরিনো বলেন, স্বর্ণ বিক্রি করে দেশের ঋণ সমস্যার সমাধান হবে না। অর্ধেক বিক্রি করলেও ঋণের পরিমাণ অল্পই কমবে।
অন্যদিকে সমালোচকেরা বলছেন, ভল্টে পড়ে থাকা স্বর্ণের কিছু অংশ বিক্রি করে জনসেবায় বিনিয়োগ করা যেতে পারে। তবে ব্যাংক অব ইতালি তাদের নীতি নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি।
কাসেলি বলেন, বিশ্ব এখন নতুন করে বিন্যাস হচ্ছে। বাজারে রেকর্ড মূল্য, আর ডিজিটাল সম্পদ যেমন ক্রিপ্টোকারেন্সি জনপ্রিয় হচ্ছে। এই বাস্তবতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো স্বর্ণ বিক্রি না করে ঠিক কাজ করছে। উৎস: বাংলাট্রিবিউন।