
জীবাশ্ম জ্বালানির ফাঁদে শিশুদের ভবিষ্যৎ: বায়ুদূষণকে বলছে ‘অদৃশ্য হত্যাযন্ত্র’
বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে বায়ুদুষণে শিশু মৃত্যুর ঘটনা নীরব মহামারি হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বেলজিয়াম ভিত্তিকি গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিরো কার্বন অ্যানালাইটিকস (জেডসিএ) এর এক নতুন এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
‘স্ট্রাকচারাল ডিপেনডেন্সিস পারপেচুয়েট ডিসপ্রোপোর্শনেট চাইল্ডহুড হেলথ বার্ডেন ফ্রম এয়ার পলিউশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ সময় বুধবার রাতে (১৫ অক্টোবর) প্রকাশ করা হয়।
এতে বলা হয়েছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ এখন বায়ুদূষণ। বিশ্বে এ বয়সে যত শিশু মৃত্যু ঘটে তার এক-চতুর্থাংশেরও বেশির জন্য দায়ী বায়ুদূষণ। আর এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বায়ুদুষণ কেবল মৃত্যুর কারণই নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি রোগের মাধ্যমে সারা জীবনের ক্ষতিও ডেকে আনছে।
প্রতিবেদন বলছে, উন্নত দেশের শিশুদের তুলনায় স্বল্পোন্নত দেশের শিশুদের বায়ুদূষণে মৃত্যুর ঝুঁকি ৯৪ গুণ বেশি। এই বৈষম্যের মূল কারণ হিসেবে দীর্ঘদিনের জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা, দূষণ নির্ভর অবকাঠামো নির্মাণ, জীবাশ্ম জ্বালানির অধিক ব্যবহার, প্রাতিষ্ঠানিক স্থবিরতাকে দায়ী করেছেন গবেষকরা।
জাতীয় বক্ষব্যধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ডা সাজিদ হোসেন খান বলেন, ‘বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য বায়ুদূষণ আজ অন্যতম বড় হুমকি। আমরা জানি, বায়ুদূষণের সংস্পর্শ শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ আরও নানা জটিলতার সঙ্গে জড়িত। বিশুদ্ধ বাতাস যেমন প্রয়োজন, তেমনি বিশুদ্ধ পানিও অপরিহার্য। আমাদের শিশুদের টিকে থাকা, সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা এবং বিকশিত হওয়ার জন্য বায়ু দূষণ কমাতে এখনই দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।’
গৃহস্থালী ও ইটভাটার দূষণ: প্রতিবেদনটি তৈরির কেস স্টাডি হিসেবে জেডসিএ এর গবেষকরা বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল ও নাইজেরিয়ার বায়ু দূষণ পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করেছে। এতে দেখা যায়, শিল্পকারখানার নির্গমন, গৃহস্থালি-ইটভাটার দূষণ, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও যানবাহনের ধোঁয়া বাংলাদেশে শিশুদের ওপর ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
বিশ্বের সর্বাধিক দূষিত দেশের তালিকায় শীর্ষে থাকা বাংলাদেশে শুধু ২০২১ সালেই ১৯ হাজারের বেশি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু বায়ুদূষণ-সম্পর্কিত কারণে মারা গেছে—যা গড়ে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় দুইজন।
ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের আগমনে দ্রুত নগরায়ণের ফলে ইটভাটা-নির্ভর নির্মাণ শিল্প বায়ুদূষণের বড় উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ইটভাটা থেকে নির্গত সূক্ষ্ম কণা (পিএম২.৫) পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের নিউমোনিয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অন্যদিকে, পরিচ্ছন্ন রান্নার প্রযুক্তি সুবিধায় এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে বাংলাদেশ। কাঠ, গোবর ও কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়ায় গৃহস্থালি পরিবেশ বিষাক্ত হচ্ছে, যার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে গর্ভবতী মা, নবজাতক ও অল্পবয়সী শিশুদের ওপর।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়—উচ্চ দূষণকারী জ্বালানি ব্যবহারকারী মায়েদের নবজাতকের ওজন কম হওয়ার ঝুঁকি ২.৬ গুণ বেশি। দুষিত বায়ু চলাচল করে এমন ঘরে নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি চার গুণ বেশি। ৩ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুরা কঠিন জ্বালানির ধোঁয়ায় থাকলে তাদের মানসিক বিকাশে বিলম্বের ঝুঁকি ৪৭ শতাংশ বেশি।
প্রতিবেদনে নাইজেরিয়ার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জায়নব ইয়ারো বলেন, ‘একটি শিশুকে দেওয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী টিকাগুলোর একটি হলো বিশুদ্ধ বাতাস। বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণ শিশুদের অবাধ বেড়ে ওঠা, শিখন এবং বিকশিত হওয়ার সুযোগ নীরবে ছিনিয়ে নেয়। যখন একটি শিশু নিঃশ্বাস নিতে সংগ্রাম করে, এটি শুধু চিকিৎসাগত সমস্যা নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক ও পরিবেশগত অবিচার। ফলে প্রতিটি শিশু যেন তাদের ঘর ও সমাজ থেকে পরিষ্কার ও নিরাপদ বাতাস পায় সেটি সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে।’
অর্থায়ন বৈষম্য: মানবিক ক্ষয়ক্ষতির বিপরীতে বায়ু দুষণ কমাতে বৈশ্বিক বিনিয়োগ চিত্র ভয়াবহ বৈপরীত্য তৈরি করেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানি ভর্তুকিতে ব্যয় হয়েছে বছরে গড়ে ৫৯৩ বিলিয়ন ডলার—কিন্তু এর এক শতাংশেরও কম অর্থ ব্যয় হয়েছে বায়ুদূষণ মোকাবিলায়।
গবেষকদের ভাষ্য, ‘পুঁজির এই ভুল বণ্টন দূষণ-নির্ভর কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করছে এবং শিশুদের অসুস্থ করে তুলছে। এই নির্ভরতা ভাঙতে হলে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি, উন্নয়ন ও পরিবেশগত ন্যায়ের সমন্বিত রূপান্তরমূলক সিদ্ধান্ত লাগবে।’
প্রতিবেদনটির প্রধান গবেষক জোয়ান বেন্টলি-ম্যাকক্যুন বলেন, ‘বায়ুদূষণ শুধু পরিবেশগত ইস্যু নয় — এটি এখন ন্যায্যতার প্রশ্ন। শিশুরা মারা যাচ্ছে এমন জ্বালানি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে, যা তারা তৈরি করেনি।’
সংকট সমাধানে বেশ কিছু দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ইটভাটা প্রযুক্তি উন্নত করলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে সাশ্রয় হবে তা বিনিয়োগ ব্যয়ের চেয়ে বেশি লাভজনক। আর পরিচ্ছন্ন রান্নার চুলায় পুরোপুরি রূপান্তর ঘটাতে পারলে প্রতিবছর ১৬ হাজারেরও বেশি শিশুমৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। এছাড়া অবশ্যই জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তর ঘটাতে হবে।