371187

জলবায়ু পরিবর্তনের দাপটে বাংলাদেশের কৃষি ও অর্থনীতি: ঝুঁকিপূর্ণ দেশের বর্তমান বাস্তবতা

কামাল হোসেন।।   জলবায়ু পরিবর্তন শুধু ভবিষ্যতের সমস্যা নয়—এটি বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, নিম্নাঞ্চলীয় ভূমি এবং ব্যাংকনির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামো মিলেমিশে বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে রেখেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, অনিয়মিত বৃষ্টি, লবণাক্ততা এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির মতো প্রভাব দেশে কৃষি, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করছে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: আন্তর্জাতিক প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (IPCC) এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, শিল্পবিপ্লবের পর থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার, বন উজাড় এবং মানবসৃষ্ট কার্যকলাপের কারণে গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলশ্রুতিতে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা শিল্পপূর্ব সময়ের তুলনায় ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২১০০ সালের মধ্যে এটি ১.৮ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে।

এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় এবং তাপপ্রবাহের মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনা তীব্র ও ঘন হয়ে উঠছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ৩৪ কোটির বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়েছিল, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আরও বাড়ছে।

বাংলাদেশে প্রভাব: জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষি, অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত জলের অনুপ্রবেশ ঘটছে। খুলনা বিভাগে প্রায় ৪ লাখ হেক্টর জমি লবণাক্ততার কবলে পড়েছে। ১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে গড় তাপমাত্রা ১.২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ধান ও গমের উৎপাদন হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও এটি অনিয়মিত হওয়ায় বন্যা ও খরার ঝুঁকি বাড়ছে। প্রতি বছর ৩০–৪০ লাখ হেক্টর জমি খরার শিকার হচ্ছে।

সিডর, আইলা ও আম্ফান-এর মতো ঘূর্ণিঝড় কৃষিজমি, অবকাঠামো ও মানুষের জীবনকে বিধ্বস্ত করছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। খরা, বন্যা ও লবণাক্ততা মাটির পুষ্টি উপাদান কমিয়ে ফসলের ফলন হ্রাস করছে।

অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্য: বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপি ২ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। কৃষি, মৎস্য ও বস্ত্রশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি প্রায় ১৭ শতাংশ ভূমি নিমজ্জিত করতে পারে, যার ফলে ২০ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারেন।

জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে, তীব্র গরম হিটস্ট্রোক ও ডিহাইড্রেশনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। মশাবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া এবং পানিবাহিত রোগ যেমন কলেরা ও ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বাড়ছে।

সমাধান ও পদক্ষেপ: বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা জলবায়ু-সহনশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) খরা, লবণাক্ততা ও বন্যা-সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছে, যেমন ব্রি ধান-৭১, ব্রি ধান-৭৮ এবং ব্রি ধান-৯৯।

ফসলের জল সংরক্ষণ, সোলার সেচ পাম্প, ভাসমান কৃষি পদ্ধতি, জৈব সার ও কম্পোস্ট ব্যবহার, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র এবং ম্যানগ্রোভ রোপণের মতো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মিথেন নিঃসরণ কমাতে ধানচাষে বিকল্প ভেটিং ও ড্রেনিং (AWD) পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, জলবায়ু-স্মার্ট কৃষি (CSA) পদ্ধতি বাংলাদেশের কৃষিকে টেকসই করতে পারে। তবে এর জন্য আন্তর্জাতিক অর্থায়ন, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও স্থায়ী নীতি প্রয়োজন।

উপসংহার: জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষি, অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য এক অস্তিত্বের সংকট। সরকারের সঠিক নীতি, কৃষিবিজ্ঞানী ও জনগণের সমন্বিত প্রচেষ্টা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা করা কঠিন। সতর্ক বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য বাংলাদেশ রাখা কঠিন হয়ে যাবে।

ad

পাঠকের মতামত