
৩৩ বছর পর জাকসু নির্বাচন: ক্যাম্পাসে উৎসবের আমেজ, শতভাগ নিরাপত্তার আশ্বাস প্রশাসনের
দীর্ঘ ৩৩ বছর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। রাত পোহালেই বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। কে হবেন ভিপি (সহসভাপতি), কে হবেন জিএস (সাধারণ সম্পাদক) বা এজিএস (সহ-সাধারণ সম্পাদক), আবার হল সংসদগুলোতে কারা এগিয়ে আছেন, তা নিয়ে আগের রাতে চলছে হিসাব-নিকেশ। এর মধ্যে একদল শিক্ষার্থী সারা ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নির্বাচনের আমেজ কেমন, সেটি বোঝার চেষ্টা করছেন। সব মিলিয়ে ক্যাম্পাসে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও স্বাভাবিক আছে।
এবার নবমবারের মতো ভোট হচ্ছে। ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে ভোটকেন্দ্র তৈরির কাজ। ভোট গণনার কার্যক্রম সরাসরি দেখানোর জন্য ক্যাম্পাসের অদম্য ২৪ চত্বরে ডিজিটাল স্ক্রিন বসানো হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নির্বিঘ্ন করার জন্য ক্যাম্পাস এলাকায় মাইকিং করে নির্দেশনা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বহিরাগতরা ছেড়েছেন ক্যাম্পাস।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্র জানায়, নির্বাচন উপলক্ষে সংশ্লিষ্ট সব মহলের প্রস্তুতি সম্পন্ন। এই নির্বাচনে শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিতের আশ্বাস দিয়েছে পুলিশ। ফলে কোনও ধরনের শঙ্কা কিংবা ঝুঁকি নেই।
২৫ পদে লড়ছেন ১৭৭ জন প্রার্থী: নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এবার জাকসুর ২৫টি পদে লড়ছেন ১৭৭ জন প্রার্থী। নির্বাচনের মোট ভোটার ১১ হাজার ৯১৯ জন। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে জাকসু কার্যকর ভূমিকা পালন করবে বলে প্রত্যাশা সবার।
২১টি কেন্দ্রের নিরাপত্তায় সিসি ক্যামেরা: ওএমআর ব্যালট পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করা হবে। ২১টি ভোটকেন্দ্রে বুথ থাকবে ২২৪টি। ২১ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা, ৬৭ জন পোলিং কর্মকর্তা ও ৬৭ জন সহকারী পোলিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফটকসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পুলিশের এক হাজার ২০০ সদস্য মোতায়েন থাকবে। তাদের অধিকাংশই ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করবেন। পাশাপাশি কেন্দ্রগুলোতে আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন। কেন্দ্রের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণে প্রায় ৮০টি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে এসব সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে কেন্দ্রের পরিবেশ নজরদারি করা হবে। জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি টিম, প্রক্টরিয়াল বডি ও ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা পুরো ক্যাম্পাসে দায়িত্ব পালন করবেন। দুজন ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্বে থাকবেন। জাকসুর জন্য তিন পৃষ্ঠার এবং দুটি হলের জন্য দুই পৃষ্ঠার এবং বাকি হলগুলোর জন্য এক পাতার ব্যালট পেপার ছাপানো হয়েছে।
ভোটের সময়: বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রতিটি কেন্দ্রে জাকসু এবং হল সংসদে শিক্ষার্থীদের ভোট গ্রহণ চলবে। একজন ভোটার ভোট দেবেন ৪০টি করে; কেন্দ্রীয় সংসদে ২৫টি, হল সংসদে ১৫টি পদে। ভোট শেষে গণনা শুরু হবে। এতে তিন থেকে চার ঘণ্টা লাগবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ভোটারদের ব্যাগ, মোবাইল ফোন, স্মার্ট ওয়াচ, যেকোনো ধরনের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, পানির বোতল ও তরল জাতীয় কোনও পদার্থ নিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশ করা যাবে না।
আটটি প্যানেলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা: এবারের জাকসু নির্বাচনে মোট আটটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। প্যানেলগুলো হলো—জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেল, ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস)-সমর্থিত ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’, ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ) ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘সম্প্রীতির ঐক্য’, সমন্বয়ক আবদুর রশিদ জিতুর নেতৃত্বে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’, ছাত্র ইউনিয়ন অপর অংশের সমর্থিত ‘সংশপ্তক পর্ষদ’, জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের একাংশের নেতৃত্বে গঠিত ‘স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ’ এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টোর প্যানেল। এগুলোর বাইরে বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
মোট ভোটার: চূড়ান্ত তালিকা অনুযায়ী, ২১টি আবাসিক হলে মোট ভোটার ১১ হাজার ৯১৯ জন। এর মধ্যে ছাত্র ভোটার ছয় হাজার ১০২, আর ছাত্রী ভোটার পাঁচ হাজার ৮১৭।
ছাত্র হলে ভোটার: আলবেরুনী হলে ২১১, আ ফ ম কামালউদ্দিন হলে ৩৪১, শহীদ সালাম-বরকত হলে ২৯৯, মওলানা ভাসানী হলে ৫২১, ১০ নম্বর হলে ৫৪০, শহীদ রফিক-জব্বার হলে ৬৫৬, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে ৩৫৭, ২১ নম্বর হলে ৭৫২, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলে ৯৯৪, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হলে ৯৫৪ ও মীর মশাররফ হোসেন হলে ৪৭৭ জন ভোটার রয়েছেন।
ছাত্রী হলে ভোটার: নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলে ২৮২, জাহানারা ইমাম হলে ৪০০, প্রীতিলতা হলে ৪০২, বেগম খালেদা জিয়া হলে ৪১৭, সুফিয়া কামাল হলে ৪৬০, ১৩ নম্বর হলে ৫৩২, ১৫ নম্বর হলে ৫৭৬, রোকেয়া হলে ৯৫৭, ফজিলাতুন্নেছা হলে ৮০৮ ও বীর প্রতীক তারামন বিবি হলে ৯৮৩ জন ভোটার রয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি: জাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানিয়েছেন, সংবাদ সংগ্রহকারী ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার কর্মীদের সামনে সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের ব্যালট বাক্স দেখিয়ে সিলগালা করা হবে। সেজন্য কেন্দ্রগুলোতে গণমাধ্যমকর্মীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। প্রতিটি কেন্দ্রে পর্যাপ্ত সিসিটিভি ক্যামেরা থাকবে এবং আনসার বাহিনী মোতায়েন করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, ক্যাম্পাস এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবে চলাচল করছেন। এ সময় একাধিক প্রার্থীকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু শহর থেকে বাইরে, আশপাশে গ্রাম জনপদ রয়েছে, অনাকাঙ্ক্ষিত কোনও ঘটনা যাতে না ঘটে, সেজন্য পুলিশের পাশাপাশি আমরা সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে চাইবো। সেই লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর কাছে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আবেদন করা হয়েছে। তবে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো। কোনও শঙ্কা আমরা দেখছি না। গণমাধ্যম কিংবা গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও আমরা ঝুঁকিপূর্ণ কোনও তথ্য পাইনি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে।’
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আরাফাত ইসলাম বলেছেন, ‘জাকসু নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুষ্ঠু রাখতে পুলিশের পক্ষ থেকে শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাদা পোশাক ও ইউনিফর্মে প্রায় দুই হাজার পুলিশ সদস্য কাজ করবেন।’
নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ৮০টি সিসিটিভি ক্যামেরা, শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে স্ব স্ব হলে ভোট গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন জাকসু নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, নির্বাচনের সার্বিক নিরাপত্তা ও শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর স্ব স্ব হলে ভোট গ্রহণ হবে। এতে ১১টি ছাত্র হল ও ১০টি ছাত্রী হল মিলে মোট ২১ হলে ২১টি কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ২১ কেন্দ্রে সর্বমোট থাকবে ২২৪ বুথ। তবে হল সংসদ নির্বাচনে বেগম সুফিয়া কামাল হল ও নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলের সব প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। তাই এই দুটি কেন্দ্রে শুধু সংসদ নির্বাচন হবে।