366401

ড. ইউনূসের সামনে যত চ্যালেঞ্জ

নিউজ ডেস্ক।। দীর্ঘ ষোল বছর পর ৫ই আগস্ট দেশ মুক্ত হয় একদলীয় শাসনের। ওইদিন দুপুরের পর শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে মেতে ওঠে গোটা দেশ। মিষ্টির দোকানগুলো খালি হয়ে যায় মুহূর্তে। রাস্তায় নেমে আসে লাখো লাখো মানুষ।

নারী- পুরুষের পাশাপাশি বাদ ছিলনা শিশুও। অন্যদিকে একটি মহল নেমে পড়ে অরাজকতায়। ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ চলতে থাকে সমানে। বিশেষ করে দেশের থানাগুলোতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে পুলিশ প্রশাসনের মাঝে। বেশির ভাগ থানা তালা দিয়ে পুলিশ চলে যায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে কিংবা আত্মগোপনে।

রাস্তা থেকে উঠে যায় ট্রাফিক পুলিশও। ৮ই আগস্ট রাত ৯টা পর্যন্ত ছিল সরকারবিহীন বাংলাদেশ। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে চরমে। এখনো পাড়া-মহল্লায় রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন ছাত্র-জনতা। এ সময়ে পুলিশে রদবদল হয়েছে। নিয়োগ পেয়েছেন নতুন আইজিপি। পুলিশ সদস্যরা কাজে যোগদান শুরু করেছেন। ওদিকে সরকারের প্রথম দিন ছিল গতকাল শুক্রবার। বৃহস্পতিবার রাতে শপথের পর গতকাল উপদেষ্টাদের দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় কয়েকদিন যে শূন্যতা ছিল তার অবসান হয়েছে। কিন্তু ডক্টর ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শুরু থেকেই মুখোমুখি হতে হচ্ছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের। সরকার এমন সময়ে দায়িত্ব নিয়েছে যখন দেশে ভেঙে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এছাড়া, অর্থনীতির অবস্থা টালমাটাল। প্রশাসন পাড়ায় চলছে অস্থিরতা। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে চরম নীরবতা।

রাজনৈতিক সংগঠনগুলো এরই মধ্যে দ্রুত নির্বাচন দেয়ার দাবিও তুলেছে। সংবিধান সংশোধনের দাবিও আছে সঙ্গে। বর্তমান সংবিধান অক্ষুণ্ন্ন রেখে নতুন নির্বাচন দিলে যে দলই ক্ষমতায় আসুক তাদের স্বৈরাচার হতে বাধ্য করবে। তাই সংবিধান সংশোধন জরুরি। মোটকথা ছাত্রদের রাষ্ট্র সংস্কারের দাবির পুরোটাই অন্তবর্তীকালীন এই সরকারের উপর বর্তাবে। আর এই সংস্কার কীভাবে হবে? এক্ষেত্রে বিশাল চাপ থাকবে সরকারের। তবে সবকিছু ছাপিয়ে সবার আগে প্রয়োজন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনা। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ঢাকার প্রায় সব থানা থেকে সরে যায় পুলিশ সদস্যরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে থানায় থানায় হয় হামলা। কোথাও কোথাও আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায় থানা ভবন। মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে হতাহতের ঘটনা, গ্রেপ্তার এবং নির্যাতনের ক্ষোভ থেকে এসব হয়েছে। এমনটাই মনে করেন দেশের মানুষ।

সবমিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট এখন প্রকট। এমন অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনাই হবে নতুন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে পুলিশ ও জনতার মধ্যে একটা বিশ্বাস এবং আস্থা দ্রুত তৈরি করতে হবে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরে যে দুর্নীতি, নির্যাতনের সংস্কৃতি এবং জনগণের সেবা না পাওয়ার ইতিহাস এ জায়গায় আনতে হবে ব্যাপক পরিবর্তন। পুলিশ প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। এ মুহূর্তেই তা প্রয়োজন। এটাকে প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ ধরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পথচলা শুরু করতে হবে।

সত্যিকার অর্থে সকল সরকারই পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে এসেছে। কেউ বেশি, কেউবা কম। ভবিষ্যৎ কোনো সরকার যেন এটি না করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব পরিবর্তন হলে পুলিশ বাহিনীর ভেতরেও সংস্কার আসবে। এসব বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার থেকে দূরে রাখতে হবে। তাদের নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। পুলিশ জনগণের সেবক সেই মানসিকতায় পুলিশ বাহিনীকে ফিরিয়ে আনতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের দ্বিতীয় পর্যায়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। সরকারের আজ্ঞাবহ যেন না হতে পারে সে দিকটি বিবেচনা করে নতুন করে আইন করতে হবে। পুরনো আইন বাতিল করতে হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর কোনো সরকার যেন হস্তক্ষেপ করতে না পারে তা সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে। এরমধ্যে নির্বাচন কমিশন অন্যতম।

এ যাবৎ নির্বাচন কমিশন কোনোকালেই সরকারের আজ্ঞাবহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন বলা হলেও সরকারের হাত নির্বাচন কমিশন সচিবের ঘাড়ে থাকতো। সরকারের ইশারা ছাড়া সচিব চোখের পাতাও ফেলতো না। আর হাসিনার সরকারের সময় তো স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই সরকারের তেলবাজি করেছেন। সরকার হ্যাঁ বললে তিনিও হ্যাঁ। সরকার না বললে তিনিও না। এরপর বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা যাক। বিচারপতি এস কে সিনহার ঘটনা তো গোটা বিশ্বে জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ কতটুকু স্বাধীন। এছাড়া প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে যা দেখিয়েছেন তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে কতটুকু রক্ষা করতে পেরেছেন তা সকলেই দেখেছেন। তাছাড়া খায়রুল হক পরবর্তীতে সরকারের সুবিধাভোগী সাংবিধানিক পদও গ্রহণ করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা সিনিয়রকে ডিঙিয়ে জুনিয়রকে প্রধান বিচারপতি কিংবা হাইকোর্ট থেকে আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। এছাড়া বিচারপতি নিয়োগে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক কোনো আইনজীবী যেন না থাকতে পারে এ ব্যাপারে কঠিন ভূমিকা নিতে হবে সংবিধানে। এসব বন্ধ করাও বর্তমান সরকারের আরেক চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা। আর দুর্নীতি দমন করার জন্য একটি কমিশন রয়েছে। যার নাম দুর্নীতি দমন কমিশন। কিন্তু এ কমিশন কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে? এ নিয়েও রয়েছে ব্যাপক প্রশ্ন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মিডিয়ায় কোনো দুর্নীতির রিপোর্ট হলে তখন নড়েচড়ে বসে এই কমিশন। তারা নিজেরা কখনো দুর্নীতি বের করেছে- এমন নজির খুবই কম। বলতে গেলে নেই। এই দুর্নীতি দমন কমিশনকে সক্রিয় করতে হবে বর্তমান সরকারকে। এটাও একটা চ্যালেঞ্জ। দেশের এমন কোনো অফিস আদালত নেই যেখানে দুর্নীতি হয়নি। কিন্তু দুর্নীতি করেও তারা পার পেয়ে যায় দুর্নীতি দমন কমিশনের কিছু কর্মকর্তার কারণে। সরকারি অফিসগুলো থেকে ঘুষ, দুর্নীতি একেবারে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে কী করণীয় এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ভাবতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রেও আইনের সংশোধনী আনতে হলে তা করতে হবে। দেশে এর আগে রাষ্ট্র পরিচালনায় দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার আনার উপর গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের। কিন্তু সবক’টি সরকারই এক্ষেত্রে থেকেছে নির্লিপ্ত। তাই এক্ষেত্রে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। মূল কথা হলো- রাষ্ট্রব্যবস্থায় সবগুলো প্রতিষ্ঠানকেই এখন কম-বেশি সংস্কার করতে হবে।

সামপ্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক দুরবস্থায় কাহিল দেশ। রিজার্ভ পরিস্থিতি ক্রমেই নিম্নমুখী, দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী, মূল্যস্ফীতি রয়েছে অসহনীয় অবস্থায়। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের রেশ পড়ে অর্থনীতিতে। এসব কারণে অর্থনীতি হয়ে ওঠে জর্জরিত। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় দ্রব্যমূল্য সাধারণ নাগরিকের বাইরে চলে যায়। এর অন্যতম একটি কারণ সরকারি দলের লোকজনের চাঁদাবাজিকে দায়ী করে আসছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি বিগত সরকারকে। মফস্বলের কোনো শহর থেকে ঢাকার কাওরানবাজারে সবজির ট্রাক রওয়ানা দিলে পথে পথে দিতে হয় চাঁদা। দলীয় চাঁদার পাশাপাশি পোশাকি চাঁদাও দিতে হয় ট্রাকগুলোকে। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নামেও দিতে হয় চাঁদা। এতে করে কৃষকের কাছ থেকে ক্রয় করা ৫ টাকার ফুলকপি ঢাকায় হয়ে যায় ৫০ টাকা। এটা সবাই জানলেও এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষ অনেক কম দামে পণ্য হাতে পাবে। এমন অবস্থায় নতুন সরকারকে গণআস্থা ধরে রাখতে হলে শুরুতেই মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে নামিয়ে আনতে হবে। মুদ্রাবিনিময় হারকে স্বাভাবিক করতে হবে।

রিজার্ভ বাড়াতে কাজ করতে হবে। এগুলো দ্রুত করতে হবে। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ সেটা মোকাবিলায় তিন মাস যথেষ্ট নয়। এ সময়ে কোনো সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে পারবে না। আর সংস্কার না হলে সেটা রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবে না। শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে সময়ের প্রয়োজন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সে সময় দিতে হবে। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন, নিরপেক্ষভাবে তৈরি করতে যে সময় দরকার সেটা দিতে হবে। প্রয়োজনে সকল রাজনৈতিক দলকে নিয়ে বৈঠক করতে হবে। সবমিলিয়ে সরকারের সামনে কঠিন সব চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ নিয়েই দিন পার করতে হবে। সমাধানও করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বৃহস্পতিবার দেশে পা রেখেই বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে। এই স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে সব দল- মতকে ধৈর্য ধরতে হবে। দেশকে সংস্কার করা পর্যন্ত। আর এটা করতে পারলে মানুষ নতুন স্বাধীনতার সুফল পাবে। কোনো সরকার আর স্বৈরাচারী হতে পারবে না। সংবিধানই তাকে স্বৈরাচারী হতে বাধা দেবে। উৎস: মানবজমিন।

 

ad

পাঠকের মতামত