364771

‘মা, আমারে কেউ গু.লি করে মারবে না’

নিউজ ডেস্ক।। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিল হোসাইন মিয়া। পরে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগাতে লেখাপড়া ছেড়ে চিটাগাং রোড় এলাকায় বাসে ফেরি করে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করত ১০ বছরের ছোট্ট হোসাইন। ২০ জুলাই শনিবার বিকেল ৩টার দিকে বাসা থেকে বের হয় হোসাইন। এর পর সারা দিন তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাত ৯টার দিকে অপরিচিত একজনের মোবাইল ফোনে হোসাইনের ছবি দেখে শেষমেষ খুঁজে পান বাবা মানিক মিয়া। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে লাশের স্তুপে পড়ে রয়েছে নিথর হোসাইন মিয়া।

জানা যায়, শনিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে মানিক মিয়া ছেলের খোঁজে বের হন। টিয়ারসেলের গ্যাস আ.গুনের ধোঁয়ায় সড়ক তখনও অন্ধকার হয়ে রয়েছে। এদিক-সেদিক খোঁজাখুঁজি করে সন্ধান না পেয়ে বাসায় চলে আসেন তিনি। তখনও তাঁর ছেলে বাসায় ফেরেনি। এরপর দুই মেয়েকে ঘরে তালাবদ্ধ করে রেখে স্ত্রী মালেকাকে সঙ্গে নিয়ে আবার খুঁজতে বের হন তিনি। রাত ৯টার দিকে কেউ একজন মোবাইল ফোনে আহত হোসাইনের ছবি দেখান তাদের। মানিক ও মালেকা বেগম ছেলের ছবি দেখে চিনতে পারেন। এরপর তাঁরা জানতে পারেন, হোসাইনকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে। পরে তাঁরা একটি পিকআপ চালককে হাতে-পায়ে ধরে কোনো রকম রাজধানীর যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত পৌঁছান।

সেখান থেকে রাত ১১টার দিকে একটি রিকশায় করে ঢামেকে পৌঁছান। এরপর হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন ছেলেকে। কোথাও না পেয়ে কর্তব্যরত এক চিকিৎসকের কাছ থেকে জানতে পারেন ‘চিটাগাং রোড থেকে যাদের আহত অবস্থায় আনা হয়েছিল তাদের চিকিৎসা চলছে। এরপর তারা রাত ২টা পর্যন্ত হাসপাতালে ছেলেকে দেখার জন্য বসে ছিলেন। রাত ২টার পর একজন লোক এসে মানিক মিয়াকে মুঠোফোনে একটি ছবি দেখিয়ে বলেন, এটি কি আপনার সন্তান? মানিক মিয়া ছবি দেখে হ্যাঁ বললে তিনি মানিককে মর্গে নিয়ে যান। মানিক মিয়া মর্গে গিয়ে দেখেন, লাশের স্তুপের ওপর তার ছেলের গু.লিবিদ্ধ নিথর ম.রদেহ পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে মানিক মিয়া জ্ঞান হারান। মা মালেকা বেগমের চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করেন।

গু.লিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ছোট্ট হোসাইনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার বরিশল গ্রামে। তার নানার বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার রাজামেহার ইউনিয়নের বেতরা গ্রামে। হোসাইন মা-বাবার সঙ্গে চিটাগাং রোড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকত। মানিক-মালেকা দম্পতির মাহিনুর আক্তার (৮) ও শাহিনুর আক্তার (৬) নামের দুই মেয়ে রয়েছে। নিহত হোসাইনের মরদেহ গ্রামের বাড়ি আখাউড়ার বরিশল গ্রামে না নিতে পেরে ২২ জুলাই রাত ২টার দিকে নানার বাড়িতে দাফন করা হয়।

আজ শনিবার বিকেলে হোসাইনের নানার বাড়ি দেবিদ্বারের বেতরা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মা মালেকা বেগম ছেলের ছবি বুকে নিয়ে আর্তনাদ করছেন। স্বজন ও প্রতিবেশীরাও চোখে পানি ধরে রাখতে পারেননি।

কেঁদে কেঁদে মালেকা বলছিলেন, ‘ভাত খেয়ে ঘরে থাকতে বলছিলাম। ছেলে বের হয়ে যায়। আমি বারবার ডেকে ঘরে আনার জন্য যাই, আর বলি বাবা রাস্তায় গোলাগু.লি হচ্ছে, তুই বাসায় চলে আয়। ছেলে বলে মা আমি ছোট্ট, আমারে কে গু,লি করবে? আমি পোশাক কারখানায় কাজ করতাম। আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার ছেলে বলে, মা, তুমি চাকরি ছেড়ে দাও। আমি তোমার চিকিৎসার জন্য বাসে বাসে ফেরি করব। আমার ছেলে বাসে বাসে পপকর্ন, আইসক্রিম ও চকলেট বিক্রি যা আয় করত তা পুরোটা আমার চিকিৎসার খরচ দিত। আমার সোনার মানিকের কি অপরাধ ছিল? তাকে কেন গুলি করে মারা হলো? আমার ছেলেকে কেউ ফিরাই দাও।’

হোসাইনের বাবা মানিক মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে শনিবার বিকেলে মারা গেছে। মরদেহ আনতে গিয়ে কত বিপদেই না পড়ছি। এই অফিসে যাও, হেই অফিসে যাও। থানায় গিয়া জিডি কর। কত স্বাক্ষর দিছি। এরপর সোমবার ছেলের লাশ পাইছি। এই লাশ লইয়া আইতে গিয়া আরও কত বিপদ পড়েছি। সোমবার রাত ২টার দিকে দেবিদ্বারে তার নানার বাড়িতে জানাজা ও দাফন করি।’

এ বিষয়ে দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিগার সুলতানা বলেন, ‘হোসাইনের নানার বাড়িতে আমি গিয়েছি। উপজেলা প্রশাসন থেকে নিহত হোসাইনের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও তার পরিবারকে আরও সহযোগিতা করা হবে।’ উৎস: সমকাল

 

ad

পাঠকের মতামত