করোনাকালে বৃদ্ধি পেয়েছে চার ধরনের অপরাধ
নিউজ ডেস্ক: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গবেষণা প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, মহামারী শুরুর পর গত ১৫ মাসে দেশে নারী নির্যাতন, কিশোর অপরাধ, সাইবার অপরাধ ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মহামারী শুরুর পর দেশে ধর্ষণের মতো অপরাধ সাধারণ সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আর দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবং স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর কিশোর বয়সী সন্তানরা অর্থ উপার্জনের আশায় কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় করোনাকালে ছিনতাইয়ের ঘটনাও আগের চেয়ে বেশি ঘটছে। তবে মহামারীতে দীর্ঘ সময় কিশোর ও তরুণ প্রজন্ম ঘরে থাকায় সাইবার অপরাধের মাত্রা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি।
ধর্ষণ : মহামারী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর ধর্ষণের মতো অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ধর্ষণের মতো অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ার হার অন্য সাধারণ সময়ের তুলনায় বেশি। বেসরকারি সংস্থা ও পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এমনটি জানা যায়। দেখা যায়, মহামারী শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ মাসে বিভিন্ন বয়সী নারী ও কন্যাশিশুর ওপর ধর্ষণের মতো নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে।
উদ্বেগজনক যে, এ সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক নারীর তুলনায় কন্যাশিশু ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটেছে। ধর্ষণের সঙ্গে ছিল গণধর্ষণের ঘটনাও। আবার ভুক্তভোগীকে ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যাও করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যাও করেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে ৫৩২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। আর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ১৩৯ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২৪ জনকে। বাংলাদেশ প্রতিদিন
মহামারীর সময়ে বেপরোয়া এই ধর্ষণের কারণ খুঁজতে গিয়ে সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা জানান, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ই এ জন্য দায়ী। তাদের মতে, দুষ্টচক্রের রাহুগ্রাস সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ায় অপরাধীরা বেপরোয়া অবস্থান নিয়েছে। সারা দেশে হঠাৎ করে ধর্ষকদের এই বেপরোয়া আচরণের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানান, মাদকাসক্ত, দুর্বল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, হতাশাগ্রস্ত ও ক্ষমতার কারণে অহংকারী ব্যক্তিরা ধর্ষণের মতো অপকর্ম ঘটাচ্ছে।
আবার সমাজে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতাও ধর্ষণের ঘটনা উসকে দিচ্ছে। মূলত মহামারীতে জবাবদিহি কম থাকার কারণে ধর্ষণের মতো অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, করোনা মহামারীতে চলাচলের শিথিলতার কারণে অনেক ধর্ষণ মামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। মহামারীতে জবাবদিহি কম থাকায় ধর্ষণের মতো অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সাইবার অপরাধ : মহামারীতে দীর্ঘ সময় কিশোর ও তরুণ প্রজন্ম ঘরে থাকায় সাইবার অপরাধের মাত্রা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। এই সময়ে আগের চেয়ে মানুষ বেশি অনলাইনে কেনাকাটা করায় ক্রেতাদের প্রতারিত হওয়ার ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার করে এখন মাত্রাহীন যৌন হয়রানি ও সাইবার অপরাধ চলছে। হয়রানির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউই। নারী ও শিশু থেকে শুরু করে সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদেরও টার্গেট করে হয়রানি করছে সাইবার অপরাধীরা। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবের মতো মাধ্যমগুলোকে বেপরোয়াভাবে সাইবার অপরাধে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে দেশে সাইবার অপরাধগুলোর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভুক্তভোগীই নারী। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় যৌন হয়রানি, বিকৃত যৌনাচার আর যৌন নিপীড়নের মতো অসংখ্য ঘটনা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের ‘বাংলাদেশে প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে যৌন নিপীড়ন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রযুক্তির অপপ্রয়োগের মাধ্যমে সাইবার স্পেসে যৌন হয়রানি, যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। গবেষণায় দেখা যায়, যৌন নিপীড়নের ক্ষেত্রে ১৫৪ জনের মধ্যে ৯২ দশমিক ২০ শতাংশ ভুক্তভোগীই নারী। প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে নারীদের ব্ল্যাকমেল করে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে। কখনো প্রেমিক, কখনোবা স্বামী ব্যক্তিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ভুক্তভোগী নারীর সঙ্গে কাটানো অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল করে দিচ্ছে। আবার অনেকে ধর্ষণের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অনেকে গোপন ক্যামেরায় বাথরুমের চিত্র ধারণ করেও অনলাইনে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফেসবুক ও টুইটারে নারীদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো এবং বাজে মন্তব্য করা এখন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ বলেন, নারীর আপত্তিকর ছবি পোস্ট করে তাকে ব্ল্যাকমেল করা সাইবার ক্রাইমের নতুন একটি ধরন, যাকে বলা হয় ‘সেক্সটোরশন’। এর মাধ্যমে কারও আপত্তিকর ছবি দিয়ে যৌন হয়রানির নামে চাঁদাবাজি করা হয়। আর টাকা না দিতে চাইলে ছবিগুলো ইন্টারনেটে ছাড়ার হুমকি দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম বয়সী তরুণ-তরুণীরা এর ফাঁদে পড়ে। ইন্টারনেটে এ ধরনের অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের বছর বছর মানসিক অশান্তির মধ্যে থাকতে হয়।
ছিনতাই : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় করোনাকালে ছিনতাইয়ের ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনায় পেশা হারিয়ে নতুন অনেক কিশোর ও তরুণ যেমন ছিনতাই করছে, একইভাবে পুরনোরাও এই অপরাধ ঘটাচ্ছে। আবার গ্রেফতারের পর সহজেই জামিন পাওয়ায় এই অপরাধীদের থামানো যাচ্ছে না। ইদানীং নতুন করে ‘টানাপার্টি’র আতঙ্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের অপরাধে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারী, বৃদ্ধ ও শিশুরা ভুক্তভোগী হচ্ছে। বেশ কিছুদিন আগে ঢাকার আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের গাড়ি থেকে তার হাতে থাকা মোবাইল ফোনটি টান দিয়ে নিয়ে যায় এক দুর্বৃত্ত।
ছিনতাইকৃত মোবাইলটি এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া সম্প্রতি মিরপুরের পল্লবী আবাসিক এলাকায় ভোরে নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার সময় রাস্তা ফাঁকা পেয়ে রিনা আক্তার নামের এক কর্মজীবী নারীর ব্যাগ টান দিয়ে দৌড়ে পালায় আরেক দুর্বৃত্ত। এ ঘটনায় ব্যাগ টানাটানিতে ভুক্তভোগী নারী হাতে আঘাত পান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনায় আগের তুলনায় রাস্তাঘাট ও সড়কে যানবাহন এবং গাড়ির উপস্থিতি কম থাকায় একটু অসতর্ক হলেই ছিনতাইকারীরা প্রাইভেট কার, রিকশা ও মোটরসাইকেল থেকে ছোঁ মেরে মোবাইল ও ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে। মূলত রাজধানীর শাহবাগ, ফার্মগেট, যাত্রাবাড়ী, বিজয় সরণি ও পান্থপথে টানাপার্টির উৎপাত বেশি। পুলিশ বেশ কয়েকজন ছিনতাইকারী ও টানাপার্টির সদস্যকে গ্রেফতার করলেও জামিনে বেরিয়ে এই অপরাধীরা আবারও পুরনো কাজে জড়িয়ে পড়ছে।
কিশোর অপরাধ : করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় কিশোর অপরাধের ঘটনাও বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে। মহামারীতে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে কিশোর অপরাধীরা সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ জন্য তারা ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ভূমিকা রাখছে টিকটকও। সম্প্রতি গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় দুই পরিবারের সদস্যদের ওপর নৃশংস হামলার সঙ্গে জড়িত কিশোর গ্যাং ‘ডি কোম্পানি’র পৃষ্ঠপোষক বাপ্পী ওরফে লন্ডন বাপ্পী এবং নীরব ওরফে ডন নীরবসহ গ্রুপটির ১২ জন সদস্যকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-১)।
এ ছাড়া ১৭ জুন ঢাকার মিরপুর মডেল থানাধীন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১টি চাইনিজ কুড়াল, ১টি ফোল্ডিং চাকু, ১টি চাপাতি, ৫০ পিস ইয়াবাসহ এলাকায় ভীতি ছড়ানোর জন্য তিন কিশোর অপরাধীকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেফতার কিশোররা মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ইভ টিজিংসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত।
প্রাপ্ত তথ্যে, কিশোর অপরাধীদের বয়স ১৪ থেকে ১৮। অথচ এই বয়সেই ধারালো ও স্বয়ংক্রিয় দেশি-বিদেশি অস্ত্র চালানো শিখে নিয়েছে। কেউ চুরি আবার কেউ ছিনতাই করছে। বয়সে ছোট হলেও পেশাদার সন্ত্রাসীর মতোই তাদের আচরণ। প্রয়োজনে মানুষ খুন করতেও তাদের হাত কাঁপে না। কিশোর বখাটেদের কেউ কেউ যৌন হয়রানিতে জড়াচ্ছে, আবার তারা সক্রিয় আছে সাইবার অপরাধেও।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, সাধারণত এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের কাজেই প্রভাবশালীরা কিশোর অপরাধীদের বেশি ব্যবহার করছে। বিগত কয়েক বছরের অপরাধের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, মাদক সেবন ও মাদক বিক্রির মতো অপরাধগুলোতেও শিশু-কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে। জানা যায়, পাড়া-মহল্লা ও বস্তির ছিঁচকে সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, এমনকি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এবং ভাসমান পথশিশু ও টোকাইরা কিশোর অপরাধে জড়াচ্ছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোররাই অপরাধে জড়াচ্ছে বেশি।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, ‘ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে শিশুরা সহিংস অনেক কনটেন্ট দেখে ফেলছে। বর্তমানে শিশুরা যে ভিডিও গেম খেলছে এর বেশির ভাগই সহিংসতামূলক। এ গেমগুলো শিশুদের সহিংস করে তুলছে। শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার দুটো ক্ষেত্রের একটি হচ্ছে পরিবার, অন্যটি তার স্কুল। আশঙ্কা করছি বেশ কিছু পরিবারের অভিভাবকের শিশুর সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের জন্য যে ভূমিকা পালন করার কথা, তা তারা করছেন না। আবার বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাও অনেক প্রতিযোগিতামূলক। সেখানে ব্যক্তিত্ব ও জীবন গঠনের শিক্ষা অনুুপস্থিত। এসব বিষয়ই শিশুকে সহিংস করে তুলছে।’