359904

বাবাকে খুঁজছে রাফসান, ছেলে হারিয়ে পাগলপ্রায় দুই মা

নিউজ ডেস্ক।।  এখনও কিছু বুঝে ওঠার বয়স হয়নি রাফসানের। বয়স মাত্র একবছর।  রোববার রাতে বাবার আদর-চুমু যে তার জন্য শেষবারের মতো হবে, তা কল্পনাও করতে পারেনি কেউ। শিশুটি কিছু বুঝতে না পারলেও আশপাশের সবার কান্নায় বারবার এদিকে-ওদিক মাথা নেড়ে যেন বাবাকেই খুঁজছে সে।

এদিকে বাবা বাবা বলে অঝোরে কাঁদছে ১১ বছরের তাহমিনা আক্তার ও সাতবছরের সাঈদ আল হোসেন।

রাফসান সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মো. নাঈম উদ্দীনের ছেলে। আর তাহমিনা ও সাঈদ একই দুর্ঘটনায় নিহত আবু সৈয়দের ছেলে-মেয়ে। নিহত মো. নাঈম উদ্দীন (৩৫) ও আবু সৈয়দ (৪৫) সম্পর্কে আপন মামাত ভাই। দুই ভাইয়ের করুণ মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে চট্টগ্রাম নগরে তাদের স্থায়ী নিবাস ইসলাম হাজির বাড়ি ও আলী হোসেন মিস্ত্রির বাড়িতে।

একই দুর্ঘটনায় মারা গেছেন আরও দুইজন। তারা হলেন, সাদমান চৌধুরী (২৭) ও আলী নেওয়াজ জনি (৩৫)। রোববার দুপুরে যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের মালঞ্চিতে তাদের বহনকারী প্রাইভেটকারের সঙ্গে একটি ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় শাহাবুদ্দিন নামে আরও একজন আহত হয়েছেন।

নিহতদের মধ্যে সাদমান চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সহ সভাপতি ও বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ইকবাল চৌধুরীর বড় ছেলে। আসন্ন কোরবানির ঈদে এক হাটে গরু কিনে আরেক হাটে বিক্রি করে বাড়তি লাভ করবেন, সে আশায় নিহত চারজনসহ পাঁচজন শনিবার রাতে যশোরের উদ্দেশে প্রাইভেটকার নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিয়েছিলেন।

৩৫ লাখ টাকা দিয়ে গরু কিনে তা চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাটে বিক্রি করবেন বলে এত দূরের পথ পাড়ি দেন তারা। কিন্তু এ পাড়ি দেওয়া যে তাদের জন্য শেষ হবে, তা ভাবতেও পারেনি কেউ। গরু আনতে গিয়ে নিজেরা লাশ হয়ে ফিরেছেন প্রিয়জনদের কাছে।

শনিবার রাতে বাসা থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ‘আমার বৌ-বাচ্চাদের দেখে রাখিও’ এমন বলে বাসা থেকে হাসিমুখে বিদায়ও নিয়েছিলেন নিহত আবু সৈয়দ।

নাঈম ও সৈয়দের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের নাম ধরে বিলাপ করতে করতে বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধ বাবা মো. ইসমাইল ও মা আনোয়ারা বেগম। আর একবছরের কোলের সন্তানকে নিয়ে অঝোরে কাঁদছেন স্ত্রী লুৎফা। সম্পর্কে আপন মামাত ভাই দুজনের বাড়িও ছিল রাস্তার এপার-ওপার।

ইসলাম হাজির বাড়ি পার করে কিছুদূর পরেই আলী হোসেন মিস্ত্রির বাড়ি। সেখানে পরিবার নিয়ে থাকতেন আবু সৈয়দ। বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, আশপাশের পুরো এলাকাজুড়ে সুনসান নীরবতা। আবু সৈয়দের বাড়িতে পৌঁছানোর আগেও কানে আসে কান্নার শব্দ। তার এমন করুণ মৃত্যুতে কাঁদছেন প্রতিবেশীরাও। সবার মুখে একটিই কথা ‘মানুষ হিসেবে খুব ভালো ছিলেন আবু সৈয়দ’।

ঘরের সামনে যেতে না যেতেই এক কোনায় বসে বাবার জন্য কান্না করতে দেখা যায় বড় মেয়ে তাহমিনাকে। তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে তার ছোট ভাই সাঈদও। স্বামীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে ছেলে-মেয়েকে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন স্ত্রী তাসলিমা আক্তার। ছেলে হারিয়ে বাকরুদ্ধ বৃদ্ধা মা জাহানারা বেগমও। ‘আমার ছেলেকে আইনা দে’- এমন বিলাপ করতে করতে কিছুক্ষণ পর পর অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন তিনি।

চারভাই ও দুইবোনের মধ্যে তৃতীয় নাঈম। ২০১৯ সালে ওই এলাকারই লুৎফার সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তার। তাদের সংসারে একবছরের ছেলে রাফসান। ওই এলাকার ক্লাসি টেইলার্স ও কায়রা ফ্যাশন নামক দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন নাঈম। এসব ব্যবসার পাশাপাশি গত কয়েকবছর ধরে কোরবানির ঈদে আরও কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গরুর ব্যবসা করে আসছিলেন তিনি।

নাঈমের মৃত্যুর খবর পেয়ে তার বাড়িতে ছুটে এসে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে ব্যবসার অপর পার্টনার নুরুল আলম সমকালকে বলেন, এ কী হয়ে গেল! শনিবার রাতেও হাসিমুখে তাকে বিদায় দিয়েছি। এ বিদায় যে শেষ বিদায় হবে, কোনোদিন কল্পনাও করিনি। নাঈমসহ আমরা কয়েকজন মিলে এবারের ঈদে গরু বিক্রি করে লাভের আশায় সবাই বিনিয়োগ করেছিলাম। সবার টাকা দিয়ে বন্ধুর প্রাইভেট কার নিয়ে গরু কিনতে গিয়ে এ কী হয়ে গেল।

ভাই ভাই বলে কান্না করতে থাকা আবু সৈয়দের বড়ভাই ওসমান গণি মিন্টু সমকালকে বলেন, এ শোক কীভাবে সইব? শনিবার রাতে তাকে বিদায় দেওয়ার সময় সৈয়দ বার বার বলেছিল, আমার স্ত্রী-সন্তানকে তুমি দেখে রেখো। তাহলে কী তার মনে জেগেছিল বিষয়টি, এটা যে তার শেষ যাত্রা হবে? ছোট্ট দুটি শিশু বাবা হারা হয়ে গেল। ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় আমার বৃদ্ধ মা। সাজানো সুখের সংসার নিমিষেই তছনছ হয়ে গেল।

ব্যবসার পাশাপাশি গরু বিক্রি করে লাভের টাকায় সুখের সংসার নিয়ে বসবাস করার প্রবল ইচ্ছা ছিল আবু সৈয়দের। অনেক কষ্ট করে তিনি গড়ে তুলেন নতুন পাঁকা বাড়িও। ইতোমধ্যে একতলার কাজও শেষ করেছিলেন। কিন্তু নতুন বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আর থাকা কপালে জুটল না আবু সৈয়দের। একটি দুর্ঘটনায় তার ঠিকানা হয়ে গেল অন্ধকার কবর। উৎস: সমকাল।

 

ad

পাঠকের মতামত