355900

কোটিপতি নাইটগার্ড

নিউজ ডেস্ক।। নাইটগার্ড কাম ঝাড়ুদার তরিকুল ইসলাম। দৈনিক হাজিরা ৬০ টাকা। আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে গত ১৫ বছর ধরে ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ ভিত্তিতে কাজ করেন তিনি।

ঝিনাইদহের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হলেও তার দাপটে তটস্থ অনেকেই। তোয়াক্কা করেন না কাউকেই। রয়েছে ব্যক্তিগত লাঠিয়ালি বাহিনী। অফিসার, অফিস স্টাফ ও দলিল লেখক সবাই একপ্রকার জিম্মি তার কাছে। তার কথা মতো কাজ না করলে স্টাফদের মারধর ও গালিগালাজ করেন- এমন অভিযোগ হরহামেশাই তার বিরুদ্ধে।

মাস্টার রোলের এই চাকরি করেই কোটিপতি বনে গেছেন তিনি। নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ছাড়া অফিসের সবকিছু তিনিই সামাল দেন এমন অভিযোগ অনেকের। নামে-বেনামে রয়েছে মহেশপুর শহরে তার অঢেল সম্পদ ও আলিশান বাড়ি।

তরিকুল মহেশপুর উপজেলার নেপা ইউনিয়নের সেজিয়া গ্রামের রবিউল কারিকরের ছেলে। বর্তমানে মহেশপুর শহরের অভিজাত এলাকায় জমিদারপাড়ার মালিপুকুরপাড়ে বসবাস করছেন। সরজমিন সেজিয়া গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, নাইটগার্ড তরিকুলের পিতার ৫-৬ বিঘা জমি ছিল। ৫ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে ওই জমি বণ্টন হওয়ার পর এখন দু’আড়াই বিঘা জমি থাকতে পারে গ্রামের মাঠে। তার প্রতিবেশী নেপা ইউনিয়ন পরিষদের দফাদার শফিকুল ইসলামও এ তথ্য জানান।

তবে নেপা ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও মহেশপুর এসিল্যান্ড অফিস তরিকুলের পিতার পৈত্রিক সম্পত্তির তথ্য দিতে পারেনি। মহেশপুর উপজেলা সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে তথ্যানুসন্ধান করে জানা গেছে, ২০২০ সালের ৩রা ডিসেম্বর একদিনে মহেশপুর পৌর এলাকায় সাড়ে ১১ বিঘা জমি (৩৮৪.৭৫ শতক) কিনে আলোচনায় আসেন নাইটগার্ড তরিকুল।

এই জমির দালিলিক মূল্য ৬৮ লাখ ১০ হাজার দেখানো হলেও প্রকৃত দাম কয়েক কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে একজন নাইটগার্ডের জমি কেনা নিয়ে হৈ চৈ পড়ে যায়।

বিতর্ক এড়াতে তিনি এখন তার ভায়রা ভাই মুদি দোকানদার হাফিজুর ও তার ভাইদের নামে জমি কিনে চলেছেন। সম্প্রতি নাইটগার্ড তরিকুল মালিপুকুর পাড়ে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে ১০ শতক ও দুই শতক জমিসহ ৩১ লাখ টাকা দিয়ে বাড়ি কিনে ভায়রার নামে রেজিষ্ট্রি করেছেন বলে কথিত আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অফিস স্টাফ ও সাধারণ দলিল লেখকরা জানান, নামপত্তনহীন জমি রেজিষ্ট্রি করতে দলিল প্রতি মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেন নাইটগার্ড তরিকুল।

জমির শ্রেণির পরিবর্তন করে জাল পর্চা তৈরি, ফি ও রেট কালেকশন থেকে শুরু করে সবই করেন এই নাইটগার্ড। বড় অঙ্কের দলিল হলে তার রেট (ঘুষ) সমিতির নামধারী নেতাদের কিছু দিয়ে বাকি টাকা পকেটস্থ করেন তিনি। সাংবাদিকদের দেয়ার নাম করেও প্রতি সপ্তাহে চাঁদা তোলেন ১৬ হাজার টাকা। এভাবেই দুর্নীতি করে গত ২০ বছর ধরে নাইটগার্ড তরিকুল অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে টাকার পাহাড় গড়েছেন।

অভিযোগ উঠেছে, চাকরি ঝাড়ুদার ও নাইটগার্ডের পদে কিন্তু কস্মিনকালেও তিনি রাতে অফিস পাহারা দেননি। অফিসও ঝাড়ু দেননি কখনো। অবৈধ সম্পদ আড়াল করতে ভাই শফিকুল ইসলামের নামে জমি কিনে রেখেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে মহেশপুর উপজেলা সাব-রেজিষ্ট্রার সঞ্জয় কুমার আচার্য্য জানান, একদিনে তরিকুল সাড়ে ১১ বিঘা জমি কিনেছে এটা সত্য। তবে সে এই জমি তার ভাই শফিকুল ইসলামের কাছ থেকে হেবা দলিল করে নিয়েছে।

ঝিনাইদহ জেলা রেজিষ্ট্রার আসাদুল ইসলাম জানান, আমি যোগদানের পর নাইটগার্ড তরিকুল ইসলামের বিষয়ে অবগত হয়েছি। বিষয়টি তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছি। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি সরজমিন মহেশপুর উপজেলা সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস তদন্ত করবো। তিনি বলেন, আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে চাকরি নেয়া এসব কর্মচারীরা স্থানীয় ও দলীয় ছত্রছায়ায় থাকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে নানান জায়গা থেকে তদ্বির আসে। আমরা তখন নিরুপায় হয়ে পড়ি।

দুর্নীতি দমন কমিশন যশোর সমন্বিত অফিসের উপ-পরিচালক নাজমুস সায়াদাত বলেন, গত বছর নাইটগার্ড তরিকুলের বিষয়ে একটি অভিযোগ পেয়ে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। সেখান থেকে কোনো নির্দেশনা এখনো পাইনি। তিনি বলেন, নতুন করে কেউ অভিযোগ দিলে আমরা তদন্ত করে দেখবো। এসব অভিযোগের ব্যাপারে তরিকুল ইসলাম বলেন, অনেকেই আমার সম্পদের মিথ্যা তথ্য প্রচার করেন, কিন্তু আমার কিছুই নেই। ভাইকে বিদেশ যেতে টাকা দিয়েছিলাম।

বিদেশে থাকা অবস্থায় সে কয়েক বিঘা জমি কিনেছিল। তার নামে থাকা জমি দেশে ফিরে সে আমার নামে হেবা দলিল করে দিয়েছে। তিনি বলেন, আমি একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের ছেলে। আইএ পাস করেছি। ক্বারী মানুষ, ৬ বছর মসজিদে আজান দিয়েছি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। আমার অপরাধ আমি নাইটগার্ডের চাকরি করি।

এটাই মানুষের চক্ষুশূল। আমি কারো কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছি এমন কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না। এই রটনার সঙ্গে অফিসের দলিল লেখকরাই জড়িত। এখানে অন্তত ২০ জন দলিল লেখক আছে, তাদের মধ্যে অনেকে সাংবাদিকতাও করেন। আমিও জব টিভির কার্ড নিয়েছি। অপপ্রচারের জবাব দিতে ২-১ মাসের মধ্যে চাকরি ছেড়ে সাংবাদিক হবো। তরিকুল বলেন, আমার আয়কর ফাইল আছে। গত বছর আমি ৩ হাজার টাকার আয়কর দিয়েছি। এই চাকরিতে আমার চলে না বলে ‘আমানা’ গ্রুপের ডিলারশিপ নিয়েছি। উৎন: মানবজমিন।

ad

পাঠকের মতামত