354684

তরুণদের জন্য শবে মেরাজের শিক্ষা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী: ‘আকাশের দরজা খুলুন।’

‘কে বলছেন?’
‘আমি জিবরাইল বলছি। সঙ্গে মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহও আছেন।’

‘আপনার সঙ্গে যিনি এসেছেন তাঁর প্রবেশের অনুমতি আছে?’

‘জি। তিনি বিশ্বরাজাধিরাজের রাজকীয় মেহমান।’

সঙ্গে সঙ্গে আকাশের দরজা খুলে গেল। বলছিলাম, মেরাজ রাতের কথা। জিবরাইল (আ.) উম্মে হানির ঘর থেকে রসুল (সা.)-কে বায়তুল মুকাদ্দাসে নিয়ে আসেন। সেখানে নবীদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও নামাজ আদায় শেষে বোরাক চড়ে আকাশ ভ্রমণ শুরু করেন। প্রথম আসমানে এসে জিবরাইল (আ.) আকাশের দরজায় নিয়োজিত ফেরেশতার সঙ্গে কথা বলে নবীজিকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেন।

ভিতরে ঢুকেই রসুল (সা.) দেখলেন একজন বৃদ্ধ বসে আছেন। তার দুই পাশে দুই দল শিশু খেলা করছে। ডান দিকের শিশুদের দিকে তাকালে তিনি হেসে ওঠেন। আর বাঁ দিকের শিশুদের দেখে তিনি হু হু সুরে কেঁদে ফেলেন। বৃদ্ধের এ আজব আচরণ দেখে রসুল (সা.) জিবরাইল (আ.)-কে বললেন, ‘ভাই জিবরাইল! ইনি কে? কেনই বা এভাবে হাসি-কান্নায় খেলা খেলছেন তিনি?’

জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘নবীজি! ইনি হলেন মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.)। তাঁর ডান পাশে যাদের দেখতে পাচ্ছেন তারা হলো ওই সব অনাগত সন্তানের রুহু, যারা দুনিয়ায় মুত্তাকি ও পরহেজগারের জীবনযাপন করবে। আর বাঁ পাশে যাদের দেখতে পাচ্ছেন তারা হলো অনাগত বদ-সন্তানের রুহু। তাই তিনি যখন ভালো সন্তানদের রুহু দেখেন তখন আনন্দে হেসে ফেলেন। আর যখন খারাপ সন্তানদের রুহু দেখেন সঙ্গে সঙ্গে দরদি পিতার দরদ নিয়ে কেঁদে ফেলেন।’ এরপর জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘হজরত! আপনার পিতা আদমকে সালাম করুন।’ হুজুর (সা.) আদম (আ.)-কে সালাম বললেন। ‘আসসলামু আলাইকুম হে মানব জাতির আদি পিতা।’ জবাবে আদম (আ.) বললেন, ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম হে নেক পুত্র আমার। স্বাগত হে নেক নবী আমাদের।’

এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয় এভাবে ষষ্ঠ আসমান পর্যন্ত বিভিন্ন নবীদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে সপ্তম আসমানের দরজায় এসে দাঁড়ান হুজুর (সা.)। সপ্তম আসমানের দরজায়ও দারোয়ান ফেরেশতার সঙ্গে প্রথম আসমানের দারোয়ান ফেরেশতার মতো কথোপকথন হয়। তারপর দরজা খুলে রসুল (সা.) শেষ আসমানে ঢোকেন। এখানেও তিনি একজন বৃদ্ধকে দেখতে পেলেন। তিনি বায়তুল মামুরে হেলান দিয়ে বসে আছেন। বায়তুল মামুর হলো ফেরেশতাদের কিবলা। আকাশরাজ্যের কিবলা প্রতিদিন অসংখ্য ফেরেশতা তাওয়াফ করে এবং আল্লাহর গুণকীর্তন করে।

রসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘জিবরাইল! এ বৃদ্ধ মানুষটি কে?’ জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘ইনি হলেন আল্লাহর বন্ধু, মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)। আপনি তাঁকে সালাম বলুন।’ সঙ্গে সঙ্গে রসুল (সা.) সালাম বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম হে আমাদের পিতা!’ ইবরাহিম (আ.)ও হাসিমুখে সালামের জবাব দিয়ে বললেন, ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম হে আমার আদরের পুত্র। মারহাবা হে আমাদের নবী (সা.)।’ এরপর রসুল (সা.) সিদরাতুল মুনতাহা হয়ে জান্নাত-জাহান্নাম দেখে প্রেমময় প্রভুর প্রেমবাসরে প্রবেশ করেন।

এই যে আদি পিতা আদম (আ.) এবং মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে শেষ নবী, শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.) সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন উম্মতে মুহাম্মদির জন্য এখানে অনেক বড় শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। আমাদের নবীজি (সা.) আদম ও ইবরাহিম (আ.)-এর চেয়ে মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ। তার পরও যখন হজরতকে বলা হলো ইনি আপনার পিতা তাঁকে সালাম করুন। নবীজি (সা.) সঙ্গে সঙ্গে বাধ্য ছেলের মতো তাঁদের সালাম বললেন। এর মাধ্যমে হুজুর (সা.) উম্মতকে এ শিক্ষাই দিতে চেয়েছেন, তুমি যত বড়ই হও না কেন, দুনিয়ার নিয়মে যে তোমার মুরব্বি তাঁকে প্রাপ্য সম্মানটুকু তোমাকে দিতেই হবে। তুমি যত আধুনিক, যত মডার্ন হও, তোমার বয়োজ্যেষ্ঠকে সম্মান দেখাতেই হবে।

দুঃখজনক হলেও সত্য! যে নবী শ্রেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি ছিলেন বিনয়ী, সেই নবীর উম্মত আজ প্রবীণদের প্রতিই বেশি কঠিন। তরুণদের রূঢ় আচরণে অনেক প্রবীণই তটস্থ থাকেন আজ। এক প্রবীণ তো বলেই ফেলেছেন, আগে আমরা মুরব্বিদের ভয় পেতাম, না জানি বেয়াদবি হয়ে যায়। আর আজ ছোটদের ভয় পাই, না জানি বেয়াদবি করে বসে। মাটির পৃথিবীতে মানুষের নবী তো বিনয়ের চর্চা করেছেনই, ঊর্ধ্বজগতেও তিনি উম্মতের জন্য বিনয়ের শিক্ষা রেখে গেছেন। আজকের যুবসমাজ যদি নবীজি (সা.) -এর বিনয়ী রং ধারণ করতে পারত তবে বিশ্বপ্রবীণদের জন্য মুসলিম তরুণরা আদর্শ হতো। আফসোস! তা না হয়ে আজ আমরা বৃদ্ধাশ্রম-ওল্ড হোম এবং প্রবীণদের জন্য নির্যাতনের আদর্শ বাড়ি বানিয়ে তাঁদের ওখানে চালান করছি। প্রবাদ বানিয়ে নিয়েছি, বুড়ো মানুষকে বৃদ্ধ হোমে দাও।

হে তরুণ! কে তোমাকে ওল্ড হোমের ঠিকানা জানাল? যাঁদের জন্য আজ তুমি তরুণ পাখি হয়ে আকাশে ডানা মেলছ, তাঁদেরই চাও চার দেয়ালে বন্দী করতে? ছি! যুবক! তুমি কি ভুলে গেছে কোরআনের সেই আয়াত? যেখানে বলা হয়েছে বুড়ো বাবা-মায়ের জন্য ওল্ড হোমের দেয়াল নয়, তোমার দুটি ডানা বিছিয়ে দাও। হে আল্লাহ! বিশ্বপ্রবীণদের জন্য আজকের তরুণদের আপনি শবেমেরাজের শিক্ষার দাওয়াত পৌঁছে দিন।

লেখক : মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

ad

পাঠকের মতামত