354524

শিক্ষানবিশ নারী চিকিৎসককে হত্যায় সহকর্মী: ‘আত্মহত্যার চিরকুটে’ মিলল হত্যার ক্লু

নিউজ ডেস্ক।। বিছানায় পড়ে ছিল শিক্ষানবিশ চিকিৎসক সিরাজুম মনিরা সোমার (২৬) নিথর দেহ। আর শয্যার পাশে ছিল একটি চিরকুট। তাতে লেখা- ‘বিদায় ডাক্তার সাহেব। আমি হাল ছেড়ে দিচ্ছি।’ সেখানে ঘুমের ওষুধের খালি পাতাও পাওয়া যায়।

রাজধানীর খিলক্ষেতের আমতলীর অন্বেষা গলির ১৯২/৬-এ নম্বর বাসার চতুর্থ তলার ফ্ল্যাট থেকে গত ২৫ জানুয়ারি সোমার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ভাড়াটিয়া তথ্য ফরমে স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়েই ওই ফ্ল্যাটে তিনি আরেক শিক্ষানবিশ চিকিৎসক এস এম রাকিবুল আজাদ ইমরানকে (২৭) নিয়ে থাকতেন। ঘটনার দিন সকালে ইমরান বাড়ির মালিকের কাছে গিয়ে দাবি করেন, তার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। রাতে দু’জনের মধ্যে ঝগড়া হয়। এ নিয়ে অভিমান করে আত্মহননের পথ বেছে নেন সোমা। ‘আত্মহত্যার চিরকুট’, ঘরের দরজা ভেঙে ঢোকার আলামত ও ইমরানের ভাষ্য দেখে প্রথমে সবাই ধরে নেয়, এটি সত্যিই আত্মহত্যা।

পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অপরাধ পর্যালোচনা সভায় এই মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানেই ঘটনাস্থলের আলামতের সঙ্গে অন্তত চারটি জায়গায় ইমরানের বক্তব্যের অমিল পাওয়ার কথা জানানো হয়। এর পরই মামলাটির তদন্তভার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে স্থানান্তর করা হয়।

তাদের তদন্তে উঠে আসে, কেন কী কারণে কীভাবে পরিকল্পিতভাবে সোমাকে হত্যা করে আত্মহত্যার নাটক সাজান ইমরান। হত্যার দায় স্বীকার করে ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করে গতকাল রোববার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন ইমরান।

স্বজন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, সোমা ও ইমরান দু’জনই চীনের নানচাং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারি পাস করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পরিচয় হয়। ২০১৭ সালে দেশে ফিরে তারা বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সোমা প্রথমে বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর মনোকষ্টে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান।

তখন তিনি কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এ সময় প্রায়ই সোমার সঙ্গে দেখা করতে হাসপাতালে যেতেন ইমরান। তাকে মানসিক শক্তি ফেরাতে সহযোগিতা করেন। ওই সময় সোমা ও ইমরানের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর পর বিএমডিসি পরীক্ষায় দু’জন পাস করার পর ২০২০ সালের মার্চ থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ইন্টার্ন শুরু করেন। তখন থেকেই স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে খিলক্ষেতে তারা বাসা ভাড়া নেন।

তদন্ত সূত্র জানায়, একই বাসায় থাকলেও সন্দেহপ্রবণতার কারণে তাদের মধ্যে প্রায় প্রতিদিন ঝগড়া হতো। অন্য কারও সঙ্গে একই ধরনের সম্পর্ক রয়েছে- দু’জনই এটা ধারণা করতেন। সর্বশেষ গত ২৩ জানুয়ারি একটি পরীক্ষা দেওয়া ও যুক্তরাজ্যে যাওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়।

ইমরানকে জিজ্ঞাসাবাদে জড়িত একটি সূত্র জানায়, উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সোমা। কিন্তু ইমরান তাকে বলতেন, সেখানে গিয়ে একই ধরনের সম্পর্কে জড়াবেন সোমা। সোমাও ইমরানকে বলতেন, ‘আমি লন্ডন চলে গেলে তুমিও তো দেশে আরেকজনের সঙ্গে সময় কাটাবে।’ এসব নিয়ে বিভিন্ন সময় তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি লেগে থাকত। ২৪ জানুয়ারিও তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে ইমরানকে চড় মারেন সোমা। এ সময় বাসায় থাকা কলা-রুটি তার মুখের ওপর ছুড়ে মারেন।

সূত্র জানায়, সোমার হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার পরই তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নেন ইমরান। ২৫ জানুয়ারি একই বাসায় আলাদা রুমে ঘুমান তারা। ভোরে সোমার রুমের দরজা খুলে ইমরান দেখেন, তার কোনো সাড়াশব্দ নেই। অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন। শয্যার পাশে ঘুমের ওষুধের খালি পাতা। তখনই ইমরানের মাথায় ভূত চাপে। পলিথিন ব্যাগ দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় সোমার মাথা থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে কালো স্কচটেপ দিয়ে পেঁচিয়ে দেন। সোমার দুই হাতও স্কচটেপে প্যাঁচানো হয়, যাতে হাত দিয়ে মুখে প্যাঁচানো পলিথিন খুলতে না পারেন। এর পরই নিজেকে বাঁচাতে সোমার হাতের অক্ষরের সঙ্গে মিলিয়ে একটি সাজানো আত্মহত্যার চিরকুট লেখেন। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লাশের সঙ্গে কাটানোর পর বাড়ির মালিককে গিয়ে তার কথিত স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি করেন তিনি।

বাড়ির মালিকের ছেলে ফাহাদ বিন হাসনাত বলেন, ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ইমরান এসে হাউমাউ করে কেঁদে বলছিলেন, ‘ভাই, আপনার ভাবি গতরাতে আত্মহত্যা করেছে। এরপর আমি ৯৯৯-এ ফোন করলে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে। ঘটনার দু’দিন পর জানতে পারি, তারা স্বামী-স্ত্রী নন। গত বছরের এপ্রিল থেকে মাসে ১২ হাজার টাকায় তারা আমাদের বাসা ভাড়া নেন। করোনার মধ্যে দু’জন চিকিৎসক ভাড়া নিতে আসছেন- কী করে তাদের সন্দেহ করব!’

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির উত্তর বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, ‘শেকসপিয়রের হ্যামলেট নাটকের চরিত্রে নায়ক নায়িকাকে হত্যা করবে কিনা, এমন দ্বিধায় ছিল। একইভাবে তরুণ চিকিৎসক ইমরানও সোমাকে হত্যা করবেন কিনা, অনেক সময় ধরে দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। শেষ পর্যন্ত নগর জীবনের জটিলতা ও কুটিলতা থেকে মুক্তির আশায় সোমাকে হত্যা করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।’

সোমার বাবা রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার উপসহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আতাউর রহমান বলেন, ‘একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। ফেব্রুয়ারিতে উচ্চ শিক্ষার জন্য তার লন্ডনে যাওয়ার কথা ছিল। তার আগেই এভাবে প্রাণ দিতে হলো। খিলক্ষেতের বাসার সব খরচ আমরা দিতাম। সেখানে অন্য কোনো বন্ধুকে নিয়ে বসবাস করে- এটা জানা ছিল না। তবে চীনে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে ইমরান দু-একবার রাজশাহীতে আমাদের বাসায় এসেছিল।’

ডিবির ক্যান্টনমেন্ট টিমের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এসএম রেজাউল হক বলেন, ‘ভিকটিমের মাথা থেকে গলা পর্যন্ত পলিথিনে মোড়ানো, স্কচটেপে আবার হাত বাঁধা। এমন অবস্থায় লাশ পাওয়া যায়। এটা দেখার পরই আমাদের সন্দেহ হয়, যার হাত বাঁধা সে কীভাবে আত্মহত্যা করবে। আবার যে চিরকুটের কথা বলা হয়, সেখানে কয়েকটি অক্ষর সোমার হাতের লেখার সঙ্গে মিলছিল না। এসব সন্দেহ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসে।’ ওই চিরকুটে ইংরেজিতে লেখা ছিল ‘বাই ডাক্তার সাহেব। আই এম গিভি আপ।’

জানা গেছে, ইমরানের বাবা কুয়েতে ভালো পদে চাকরি করেন। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া সদরে। উৎস: সমকাল।

ad

পাঠকের মতামত