353928

যেদিন থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু

নিউজ ডেস্ক।। ‘ধন্য সেই পুরুষ/ যাঁর নামের ওপর রৌদ্র ঝরে চিরকাল/ গান হয়ে নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা;/ যাঁর নামের ওপর কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া’। কবি শামসুর রাহমানের কবিতার পঙ্‌ক্তিতে উদ্ভাসিত এই পুরুষকে এ জনপদের মানুষ ভালোবেসে ডেকেছিল ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে; চিরকাল এ নামেই তাকে চিনবে মানুষ।

কারণ তিনি হয়ে উঠেছিলেন এই বাংলার বাঙালিসহ সব জনগণের মুক্তির দূত। হয়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু। কিন্তু শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের ধাপে ধাপে কণ্টকাকীর্ণ পথ বেয়েই জনতার হৃদয় নিংড়ানো এই সম্ভাষণ অর্জন করেছিলেন তিনি।

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান চলার সময় ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের গণসংবর্ধনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা, ডাকসুর সহসভাপতি,কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক তোফায়েল আহমেদ তাকে এ উপাধিতে ভূষিত করেন।

বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তাৎপর্যপূর্ণ এক মাইলফলক। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে বাঙালিকে মুক্ত করতে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন। এতে স্বাধিকার আন্দোলনের গতি তীব্রতর হয়ে উঠলে ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা করে। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রাখা হয়।

এক পর্যায়ে সামরিক শাসনের অবসান, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার, শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-জনতার গণআন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু কার্যালয়ে ডাকসু ভিপি হিসেবে তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং শেখ মুজিব ঘোষিত ৬ দফাকে পুরোপুরি অন্তর্ভুক্ত করে ১১ দফা কর্মসূচি প্রণীত হয়।

উনসত্তরের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশ থেকে ১১ দফা দাবিতে এবং ছাত্র-জনতার ওপর নির্যাতন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা লঙ্ঘনের প্রতিবাদে ২০ জানুয়ারি পূর্ণ দিবস হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। গভর্নর মোনায়েম খান ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন। মিছিলকারীদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্তমান জরুরি বিভাগের সামনে অকুতোভয় ছাত্রনেতা আসাদ শহীদ হন।

পরে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৪ জানুয়ারি ঢাকায় হরতালের ডাক দেয়। এই হরতালের সময় সচিবালয়ের সামনে মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে বকশীবাজার নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমানসহ মকবুল, রুস্তম ও আলমগীর শহীদ হন। এই আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানের সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করার শপথ নেওয়া হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. শামসুজ্জোহা নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হলে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। জারি হয় সান্ধ্য আইন। কিন্তু ছাত্র-জনতা সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে রাজপথে মিছিল করে। ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা নগরী মশাল আর মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়।

২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টনের মহাসমুদ্রে ছাত্রনেতারা বাঙালির প্রিয় নেতা শেখ মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক সবার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন। জনরোষের ভয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হন। পরদিন রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়।

২৩ ফেব্রুয়ারি ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে সেদিনের সেই সমাবেশে সভাপতি তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘যে নেতা জীবন-যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে; ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন; সেই প্রিয় নেতাকে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে একটি উপাধি দিতে চাই।’ ১০ লাখ মানুষ ২০ লাখ হাত তুলে তার এ কথায় সম্মতি জানায়। এর পরই শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন তোফায়েল আহমেদ। এর পর বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে তোমরা যারা আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছ; যদি কোনোদিন পারি নিজের রক্ত দিয়ে সেই রক্তের ঋণ শোধ করে যাব।’

সেদিন থেকে তিনি হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হয়ে ওঠেন এই দেশ-জাতি-মানুষের নয়নের মণি। হয়ে ওঠেন জাতির পিতা।

এ প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ একাধিকবার বলেছেন, সেদিনের রেসকোর্স ময়দানের গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানের কথা ভাবলে তিনি এখনও বিস্মিত হন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর ৪ মাস ১ দিন। সেই বয়সে প্রিয় নেতাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে বক্তৃতা দিয়ে জাতির পক্ষে তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা তার জীবনের একটি অতুলনীয় ঘটনা। উৎস: দৈনিক সমকাল।

ad

পাঠকের মতামত