349836

বিয়ে করে বিপাকে প্রেমিকযুগল

রাজীব-প্রেমা যুগলের প্রেম কাহিনি যেনো সিনেমাকেও হার মানিয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পরস্পরকে ভালোলাগা। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা।

তবে তাদের এ সম্পর্ক পরিণয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রেমার পুলিশ অফিসার বাবা। তিনি এ সম্পর্ক সহজে মেনে নেবেন না। সেটা ভালোই জানত প্রেমা। তাই সবাইকে গোপন করে রাজীবের সঙ্গে বিয়েটা সেরে নেয় সে।

পরে ঠিকই একসময় পুলিশ অফিসার বাবা মেয়ের প্রেমের সম্পর্কের কথা বুঝে ফেলেন। কিন্তু বিয়ের বিষয়টি অজানাই থাকে সবার কাছে।

এদিকে মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছেলেকে পছন্দ করে জেনে রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন প্রেমার বাবা। মেয়েকে বাসায় নজরবন্দি করে রাখেন মাসের পর মাস। যেনো যোগাযোগ না রাখতে পারে, সেজন্য প্রেমার মোবাইল কেড়ে নিয়ে ভেঙ্গে ফেলেন। এমনকি বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী এবং আত্মীয়দের সঙ্গেও প্রেমার যোগাযোগ বন্ধ করে দেন তিনি।

এভাবে কেটে যায় ৭-৮ মাস। এ সময়ের মধ‌্যে রাজীবের জন্য কান্নাকাটি করেও বাবার মন গলাতে পারেনি প্রেমা। বরং শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন সইতে হয়েছে তাকে। অবশেষে বাড়ি থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয় প্রেমা।

পালিয়ে স্বামী রাজীবের বাড়িতে ঠাঁই নেয়। কিন্তু হার মানতে নারাজ তার পুলিশ অফিসার বাবা। পরদিনই মিথ্যা অপহরণ মামলা ঠুকে দেন রাজীব ও তার পুরো পরিবারের নামে। এতেও ক্ষান্ত হননি ক্ষমতাধর ওই পুলিশ কর্তা। বিভিন্ন সময় মেয়ে প্রেমার শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের ওপর হামলা চালানোরও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

প্রেমা-রাজীবের সিনেমার মতো এমন প্রেমকাহিনী বাস্তবে ঘটেছে ঢাকার সাভারে। পাশের উপজেলা ধামরাইয়ের নিজ বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রেমা উঠেছে আশুলিয়ার গকুলনগর স্বামীর বাড়িতে। তবে বাবা পুলিশ কর্মকর্তা মীর শাহীন শাহ পারভেজের ভয়ে তারা আপাতত ভাড়া বাসায় রয়েছেন। রাজীবের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, ওসি শাহীন পারভেজের জন্য তারা অনেকটা বন্দিদশায় ও আতঙ্কের মধ‌্যে দিন পার করছেন।

অভিযুক্ত মীর শাহীন শাহ পারভেজ ঢাকা জেলা উত্তর (সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই থানা) এর ডিবি পুলিশের ওসি হিসেবে দায়িত্বপালন শেষে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ওসি হিসেবে যোগ দেন। পরে সেখান থেকে ক্লোজড হয়ে বর্তমানে মানিকগঞ্জ পুলিশ লাইনে কর্মরত।

সামিয়া প্রেমা বলেন, ‘‘দেড় বছর আগে আমরা বিয়ে করেছি। আমার নিজের ইচ্ছায়। বাবাকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানিয়েছিলাম। বাবা তারপর থেকে নানাভাবে সম্পর্ক ত‌্যাগের জন‌্য চাপ দিচ্ছিলেন। রাজীবের ফ্যামিলিকেও প্রেসার দেওয়া হয়েছে। আমাকেও নানাভাবে টর্চার করা হয়েছে। অনার্স কমপ্লিট হওয়ার পর আমাকে প্রায় এক বছর বাসায় আটকে রাখা হয়। কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেননি। ফোন ভেঙে ফেলেছেন।

গত ৩ নভেম্বর নিজের ইচ্ছায় আমার স্বামীর কাছে পালিয়ে আসি। এ ঘটনায় আমার মা বাদী হয়ে ধামরাই থানায় মামলা করেন। আমর্স্বোমী, ভাসুর, শ্বশুড়-শাশুড়ির নামে মামলা দেওয়া হয়। পরে আমার ভাসুরকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। মামলার পর কোর্টে গিয়ে আমি নিজে জিম্মায় আমার স্বামীর কাছে চলে আসি। আমার ভাসুরকেও জামিন দেন আদালত।”

প্রেমা বলেন, ‘আমার বাবা পুলিশের ওসি। বাবা আশুলিয়া, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জসহ বিভিন্ন থানায় ছিলেন। এখন মানিকগঞ্জ পুলিশ লাইনে আছেন। হয়তো তার (বাবা) জিদটা বেশি কাজ করছে। এখন আমি নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছি। নিজের ইচ্ছায় আসছি। সংসার করছি। তারপরও যদি বাবা আমাকে জোর করে নিতে চান, তাহলে সেটা ভুল হবে।’

অপহরণ মামলার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি বাসা থেকে যখন চলে আসছি, তখন অপহরণ মামলা করা হয়েছে। কিন্তু আমার বাবা এটা জানতেন, আমি নিজের ইচ্ছায় আসছি। আমাকে অপহরণ করা হয়নি। তারপরও তিনি মামলা দিয়েছেন। কোর্ট থেকে আসার পরে আমি আর বাবার সঙ্গে কনট্যাক্ট করি নাই। ফ্যামিলির কারও সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। বাবা জানার পরও এমন একটা হয়রানি করছে এই অভিমান-রাগ থেকেই কারও সঙ্গে যোগাযোগ করিনি।’

আলামিন রাজীব বলেন, ‘আমরা একই ইউনিভার্সিটিতে একই ডিপার্টমেন্টে পড়াশুনা করতাম। সেখানে পরস্পরকে পছন্দ করি। পরে আমরা বিয়েও করি। কিন্তু ওর কথামতো সম্মানের বিষয় ভেবে আমরা ফ্যামিলিতে কিছু জানাইনি। ও বলে, ‘বাসায় বাবাকে আমি রাজি করাব।’ কিন্তু ওর ওপর তখন অনেক প্রেসার দেওয়া হয়। আমাকেও নানাভাবে থ্রেট দেওয়া হয়। এমনকি আমার বাবাকে বিভিন্ন সময় থ্রেট দেওয়া হচ্ছে। আমার ভাইয়ের ওপর হামলা করা হয়েছে। তাই আমি প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করছি, আমাদের পরিবারকে নিরাপত্তা দেওয়া হোক।’

রাজীবের বড় ভাই সরকারি পশু চিকিৎসক ওমর আলী বলেন, ‘আমি একজন সরকারি এআই কর্মী। গত ২২ নভেম্বর সকালে বাসা থেকে আমি ও আমার সহকারী মোটরসাইকেল নিয়ে চাকল গ্রাম যাচ্ছিলাম। সেসময় তিনটা মোটরসাইকেল ও একটা প্রাইভেটকারে ৮-১০ জন লোক এসে আমার পথরোধ করার চেষ্টা করে। এসময় তারা হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে আমাকে রাস্তায় ফেলে দেয়। পরে আমি ও আমার সহকারী দৌড়ে পালিয়ে যাই। আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে সন্ত্রাসীরা দ্রুত চলে যায়।’

রাজীবের চাচাতো ভাই আসিফ মাহমুদ জানান, এসব ঘটনার পর মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় রাজীব ভাইয়ের বাবা সিন্দুরিয়া এলাকার নিজ ফার্মেসি দোকান বন্ধ করে বাসায় ফিরছিলেন। পথে দুইটা মোটরসাইকেলে চারজন দুর্বৃত্ত উনার উপর হামলা চালায়। একটা হোন্ডা থেকে হাতুড়ি দিয়ে চাচার মাথায় আঘাত করা হয়। এতে তিনি চিৎকার করে মাটিতে পড়ে যান। সেসময় আশপাশের লোকজন ছুটে গেলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। তবে যাওয়ার সময় আঘাতকারীরা আমার চাচাকে বলে ‘শাহিন পারভেজের মনের আশা পূর্ণ করলাম।’

তিনি আরও জানান, এছাড়া গত ৯ ডিসেম্বর ঢাকার কোর্টে প্রেমার বাবার দায়ের করা মামলার হাজিরার তারিখ ছিল। ওইদিন সন্ধ্যায় কোর্ট শেষে প্রাইভেটকারে বাসায় ফিরছিলেন ভাই রাজীব, তার স্ত্রী প্রেমা, বাবা রসুল হক, ভাই ওমর আলী ও মাসহ পাঁচ জন। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে উলাইল স্ট্যান্ডের কিছুটা আগে পৌঁছলে ১৫-২০ জন লাঠিসোঠা নিয়ে প্রাইভেটকারটি থামায়।

এসময় প্রেমাকে জোরপূর্বক টেনে গাড়ি থেকে নামানোর চেষ্টা করে তারা। কিন্তু পেছন থেকে আসা আরেকটা গাড়িতে সাংবাদিকরা সেখানে আকস্মিক হাজির হলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।

আসিফ বলেন, ‘২২ নভেম্বর চাচাতো ভাই ওমর আলীর উপর হামলার ঘটনায় তারা থানায় অভিযোগ করেন। কিন্তু এ ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহভাজন ওসির নাম অভিযোগে লিখতে রাজি হয়নি দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা। এমন অবস্থায় তারা আইনি সহায়তা না পেয়ে চরম উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কে দিন পার করছেন। এমনকি ইতোপূর্বে হামলার শিকার তার চাচাতো ভাই ওমর আলী মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।’

এসব অভিযোগ নিয়ে প্রেমা তার বাবা ওসি মীর শাহীন শাহ পারভেজের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেন (বাবা-মেয়ের কথোপকথনের রেকর্ড আছে)। কেন মিথ্যা অপহরণ মামলা ও তার শ্বশুর বাড়ির লোকজনের ওপর হামলা করা হচ্ছে মেয়ে প্রেমার এমন প্রশ্নে ওসি শাহীন পারভেজ বলেন, ‘মামলা দিব না? তুমি কোথায় গেছো আমি জানব ক্যামনে? মামলা দিছি বিধায়তো জানতে পারছি তুমি কোথায় আছো?

এসময় প্রেমাকে মারধরের কথাও স্বীকার করেন ওসি। তবে প্রেমার কাছে তার শ্বশুর বাড়ির লোকজনের ওপর হামলার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

অপহরণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ধামরাই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন জানান, অপরহণ মামলায় রাজীবসহ তার পরিবারের আরও চার সদস্য আসামি। মামলার পরদিন রাজীবের ভাই ওমর ফারুককে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামিরা সবাই জামিনে আছেন।

আদালতে ওসি শাহীন পারভেজের মেয়ে হাজির হয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন সে ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বিষয়টা সম্পূর্ণ আদালতের। তবে সুষ্ঠু তদন্ত করে মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে।’

আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম কামরুজ্জামান বলেন, ‘বৃদ্ধকে হাতুড়িপেটা করার ঘটনায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে। অভিযোগে একজন পুলিশ কর্মকর্তার নামও রয়েছে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও অভিযোগ করেছেন। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি।’ সূত্র: রাইজিংবিডি.কম

ad

পাঠকের মতামত