349874

মুমিনের জীবনে ঈমানের সৌন্দর্য

আল্লামা তাকি উসমানি: প্রকৃত মুমিন সে-ই, যে আল্লাহর একত্ববাদ, নবী (সা.)-এর রিসালাত এবং তাঁর প্রবর্তিত সব বিশ্বাস ও বিধানের ওপর দ্বিধাহীন বিশ্বাস স্থাপন করে। কেননা সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) মানবজাতিকে যেসব নির্দেশ দিয়েছেন তা অবশ্যই কল্যাণকর। ঈমানের দাবি হলো, মানুষ তার পুরো জীবন মহানবী (সা.)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী কাটাবে। তাঁর নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ভিন্ন কিছু গ্রহণ করবে না। কাজকর্ম, চালচলন ও আচার-আচরণে তার প্রথম বিবেচ্য হবে, আল্লাহ এই কাজের অনুমতি দিয়েছেন কি না। অনুমতি থাকলে সে করবে, না থাকলে বিরত থাকবে। জীবনকে প্রবৃত্তির তাড়নার ওপর ছেড়ে দেবে না; বরং প্রবৃত্তি দমনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করবে।

আল্লাহর নিঃশর্ত আনুগত্যের কারণে মুমিনের ভেতর উত্তম গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যের সমাহার ঘটে। কেননা আল্লাহ তাঁর বান্দাদের যেসব বিধান দিয়েছেন তার উদ্দেশ্যই হলো মানবজীবন সুন্দর করা এবং তাকে মন্দ বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা থেকে দূরে রাখা। মানুষ যখন অঙ্গীকার করে সে আল্লাহর অনুগত জীবন যাপন করবে, তখন তার জীবন সৌন্দর্য ও সুষমায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আল্লাহর আনুগত্যে মুমিনের জীবনে যেসব গুণের সমাহার ঘটে তা সংখ্যায় অগণন। তা প্রকাশ পায় পাঁচটি ক্ষেত্রে—বিশ্বাস, ইবাদত, লেনদেন, আচার-আচরণ ও চরিত্র।

বিশ্বাস : বিশ্বাস বা আকিদার ক্ষেত্রে ইসলামের মূল বক্তব্য হলো, মুমিন আল্লাহ, আল্লাহর রাসুল, শরিয়তে ইসলাম, পূর্ববর্তী নবী ও তাঁদের শরিয়ত এবং পরকালে বিশ্বাস রাখে। অর্থাৎ নবী-রাসুলরা যত বিশ্বাস ও পথনির্দেশ নিয়ে এসেছেন তা সত্য হিসেবে স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, মৃত্যুর পর তার প্রতিটি কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এই বিশ্বাসের কারণে সে রাতের আঁধারে, গভীর জঙ্গলে একাকী অবস্থায়ও এমন কাজে লিপ্ত হতে পারে না, যার কারণে পরকালে আল্লাহর সামনে লজ্জিত হওয়ার ভয় আছে।

ইবাদত : ইবাদতের ক্ষেত্রে মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো, সে নিজেকে কেবল আল্লাহর বান্দা ও অনুগত মনে করে। আল্লাহ ছাড়া কারো উপসনা করে না, কারো সামনে মাথা নত করে না, কাউকে ভয় পায় না, অন্য কারো শক্তি ও সাহায্যের দ্বারস্থ হয় না। আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের যত নির্দেশ রয়েছে, সে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। আর কোরআনের ঘোষণা হলো, সফল সেই মুমিন, যে আল্লাহভীতির সঙ্গে নামাজ আদায় করে। কোরআনে আরো বলা হয়েছে, মুমিন তারাই, যারা আল্লাহর ওপর ঈমান রাখে, নিজের প্রতিপালকের সঙ্গে কাউকে শরিক করে না, যে আল্লাহভীতি নিয়ে আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করে। কেননা সে আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার ভয় করে। তারা নেকির প্রতি দ্রুত এগিয়ে যায় এবং ভালো কাজে পরস্পর প্রতিযোগিতা করে। শারীরিক ইবাদত হোক বা আর্থিক ইবাদত, সর্বত্র মুমিন এগিয়ে থাকার চেষ্টা করে।

লেনদেন : পারস্পরিক লেনদেনে মুমিন তার কথা, কাজ ও অঙ্গীকারে সত্যবাদী হয়। কাউকে ধোঁকা দেয় না, প্রতারণা করে না; কথা দিলে পূরণ করে, অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ আত্মসাতের চিন্তাও করে না। এ জন্য কোরআনে বলা হয়েছে, সফল সেই মুমিন, যে তার আমানত ও অঙ্গীকার পূরণ করে। আর আমানত এমন বিষয়কে বোঝায়, যা মানুষ যার দায়িত্ব গ্রহণ করে, যে ব্যাপারে অন্যরা তার ওপর আস্থাশীল হয়। কোরআনে দুই প্রকারের আমানতের কথা বলা হয়েছে—এক. সম্পদ আমানত রাখলে তা ফিরিয়ে দেওয়া এবং দুই. অঙ্গীকার পূরণ করা। এটা আরো বেশি ব্যাপক। কেউ যদি কোনো গোপন কথা জানে, সেটাও তার জন্য আমানত। শরিয়ত অনুমোদিত কারণ ছাড়া মানুষের গোপন কথা প্রকাশ করা অঙ্গীকার ভঙ্গের শামিল। একইভাবে কর্মীর জন্য নিয়োগদাতার সঙ্গে অঙ্গীকারকৃত সময় পূরণ করা আমানতের অংশ। মূলত আমানত একটি ব্যাপক শব্দ, তা পারস্পরিক লেনদেনের অসংখ্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে। যেমন—পণ্যের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করা, সঠিকভাবে মেপে দেওয়া, সঠিক মূল্য পরিশোধ করা ইত্যাদি। মুমিন আমানতের সব দিক রক্ষা করে চলে। কেননা সে বিশ্বাস করে, লেনদেনে অন্যায় পন্থা অবলম্বন করে পার্থিব জীবনে সামান্য উপকৃত হলেও পরকালে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।

ইবাদতের ক্ষেত্রে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে তাওবার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব, কিন্তু লেনদেনে অন্যের অধিকার নষ্ট করলে তা শুধু তাওবার মাধ্যমে পরিশোধন হয় না। বরং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হয় এবং তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হয়।

আচার-আচরণ : মানুষের সঙ্গে মুমিনের আচার-আচরণ কেমন হবে সে সম্পর্কে মহানবী (সা.) ছোট্ট একটি মূলনীতি দিয়ে গেছেন। তা হলো, প্রকৃত মুমিন সে-ই, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুমিন নিরাপদ। সুতরাং মুমিন তার চালচলন ও কথাবার্তায় সতর্কতা অবলম্বন করবে, যেন অন্য কোনো ব্যক্তি তার দ্বারা শারীরিক ও মানসিক কষ্ট না পায়। কারো অন্তরে আঘাত করা, পরচর্চা করা, মন্দ ধারণা পোষণ করা, ছিদ্রান্বেষণ করা এবং কারো অনুমতি ছাড়া পারিবারিক পরিমণ্ডলে ঢুকে পড়া মুমিনের কাজ নয়।

চরিত্র : মুমিনের চরিত্রের ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন, চরিত্রবান ব্যক্তিই প্রকৃত মুমিন। উত্তম চরিত্রের অর্থ হলো মন্দ চরিত্র বর্জন করা এবং ভালো গুণাবলি ধারণ করা। সুতরাং মুমিন অহংকারী না হয়ে বিনয়ী, কৃপণতার পরিবর্তে দানশীল, ভীরু হওয়ার পরিবর্তে সাহসী, কঠোর স্বভাবের পরিবর্তে কোমলস্বভাব, অস্থিরতাপ্রবণ না হয়ে ধীরস্থির, রূঢ় না হয়ে মিষ্টভাষী, অশালীন না হয়ে শালীন ও মার্জিত হয়। এককথায় মানুষের জন্য প্রশংসার্হ ও গর্বের যত বৈশিষ্ট্য আছে, মুমিনের জীবনে তার সম্মিলন ঘটে। চারিত্রিক গুণে মুমিন যত সমৃদ্ধ হবে, তার ঈমান যত পূর্ণতা পাবে। আল্লাহ প্রতিটি মুমিনকে এমন বৈশিষ্ট্য দান করুন, যা ঈমানের দাবি এবং যা ঈমানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। আমিন।

ad

পাঠকের মতামত