345913

বিয়ে গোপন রেখে পুলিশের চাকরি, পরে আরেক বিয়ে

পুলিশে যোগদানের আগেই জাঁকজমকপূর্ণভাবে প্রথম বিয়ে করেন তানোর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আনিছুর রহমান। এরপর চাকরির অজুহাতে পাঁচ বছর ধরে বিয়ে গোপন রাখতে বলেন স্ত্রীকে। এ সুযোগে লুকিয়ে সিরাজগঞ্জে আরেকটি বিয়ে করেন এসআই আনিস।

বিষয়টি জানতে পেরে প্রথম স্ত্রী প্রতিবাদ করলে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেন পুলিশের এ কর্মকর্তা। ঘটনার প্রকাশ বা আইনের আশ্রয় নিলে পুরো পরিবারকে হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে নাস্তানাবুদ করার হুমকি দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে।

অভিযোগকারী নারীর ভাষ্যমতে, আনিছুর রহমান আনিস গাইবান্ধা সদরে বন্ধুর কোচিংয়ে ক্লাস নিতেন। আনিসের বন্ধুর বোনও সেই কোচিংয়ের ছাত্রী ছিলেন। এর একপর্যায়ে আনিসকে তার বন্ধু বোনের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিলে আনিস রাজি হন। জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ২০১৫ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর মোছা. রেবেকা সুলতানা মনিকে বিয়ে করেন আনিস।

বিয়েতে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেনমোহর ধার্য হয়। তার মধ্যে ১১ হাজার টাকা মূল্যের স্বর্ণের নাকফুল নগদ বুঝিয়ে দিয়ে ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী রেজিস্ট্রির মাধ্যমে তাদের বিয়ে হয়। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভালোই চলছিল তাদের দাম্পত্য জীবন। কিন্তু ২০১৮ সালে আনিস বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে শারীরিক, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। ট্রেনিং শেষে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানায় এসআই পদে যোগদান করেন। নিয়ম অনুসারে বিবাহিত কোনো ব্যক্তি পুলিশের যোগদান করতে পারবেন না, এমনকি দপ্তর থেকে বিয়ের অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত বিয়েও করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে আনিস তার স্ত্রী মনিকে বিয়ের বিষয়টি গোপন রাখার জন্য বলেন। সেই সঙ্গে যতক্ষণ পর্যন্ত পুলিশ বিভাগ থেকে বিয়ের অনুমতি না পাওয়া যাবে ততক্ষণ যেন তাদের বিয়ের বিষয়টি গোপন রাখা হয় সে বিষয়ে মনিকে অনুরোধ জানান আনিস।

ভুক্তভোগী মনির অভিযোগ, পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও এসআই আনিস সময় নিতে থাকেন। ২০২০ সালে ডিপার্টমেন্টাল অনুমতি নিতে এসআই আনিসকে বলেন মনি। তখন আনিস জানান, ২০২০ সালে অনুমতি মেলেনি, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

এসআই আনিসের স্ত্রী মনি বলেন, ‘চলতি বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখে আমাদের পঞ্চম বিবাহবার্ষিকী ছিল। আনিসের সাথে পরামর্শ করে ঘরোয়া পরিবেশে নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের নিয়ে বিকেল ৫টায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আনিস হঠাৎ দুপুর ২টায় মুঠোফোনে জানায়, ব্যস্ততার কারণে সেদিন কোনোভাবেই সে আসতে পারবে না। বাধ্য হয়ে পরদিন বিকেল ৫টায় অনুষ্ঠান পেছানো হয়। এবার আনিস অনুষ্ঠান শুরুর এক ঘণ্টা আগে জানায়, তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে কক্সবাজার পাঠানো হচ্ছে, যার কারণে সে আসতে পারবে না।’

ভুক্তভোগী মনি বলেন, ‘পরবর্তীতে আনিস তার সব নম্বর বন্ধ করে দেয়। সামাজিকভাবে অপমানিত হওয়ায় আমার চাচাতো ভাই ও চাচাদের নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাই এবং ঘটনাটি অবহিত করি। তখন আনিস তার বড়ভাইয়ের ফোনে কল করে আমাকে আশ্বস্ত করে, আগামী পনের দিনের মধ্যে আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেবে। কিন্তু তার সপ্তাহ খানেক পরে এক পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে জানতে পারি, আনিস সিরাজগঞ্জ থানার পাঙ্গাসি ইউনিয়নে গোপনে বিয়ে করেছে। ঘটনার সত্যতা পাওয়ার পর আনিসকে জিজ্ঞাসা করলে সে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং মুখ খুললে প্রাণনাশের হুমকি দেয়।’

মনি আরও বলেন, ‘সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য তাকে বারবার ফোন করলে সে যোগাযোগ করতে নিষেধ করে। এ ছাড়া আমি কোনো প্রকার বিবাদ বা আইনের আশ্রয় নিলে আমার পুরো পরিবারকে তার পুলিশি ক্ষমতায় হামলা-মামলায় জর্জরিত করে আর্থ-সামাজিকভাবে শেষ করে ফেলবে বলে হুমকি দেয়।’

এসআই আনিসের স্ত্রী আরও অভিযোগ করেন, ‘দাম্পত্য জীবনে ২০১৬ সালে আমার গর্ভের তিন মাসের বাচ্চাকে জোরপূর্বক ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে নষ্ট করে আনিস। এতে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। পরবর্তীতে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসাও নিতে হয়। শুধু তাই নয়, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আনিসের পড়াশোনার খরচ, চাকরিতে যোগদান খরচ, ট্রেনিং খরচ, নতুন বাইক কেনাসহ বিভিন্ন খরচাদি আমি করেছি, যা পাঁচ লাখ টাকার অধিক। আর এই অর্থ আমার বাবা সম্পত্তি ও বড় ভাইদের গচ্ছিত টাকা থেকে পাওয়া।’

এসআই আনিসের স্ত্রী আরও বলেন, ‘বারবার সমঝোতা করতে ব্যর্থ হয়ে কোনো উপায় না পেয়ে অবশেষে আমি রাজশাহী জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মহোদয়ের নিকট আমার স্বামীর বিরুদ্ধে গত ২৫ অক্টোবর একটি প্রতারণার অভিযোগ দাখিল করি। সেই অভিযোগপত্রের সংযুক্তিতে নিকাহনামা বা বিবাহ রেজিস্ট্রির সত্যায়িত ফটোকপি, দ্বিতীয় বিবাহের ছবি, কল রেকর্ডিং ও মেসেজ সংবলিত একটি মেমোরি কার্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগের অনুলিপি প্রদান করা হয়েছে।’

অভিযোগের বিষয়ে তানোর থানার এসআই আনিছুর রহমান আনিসকে মুঠোফোনে কল করলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে জানান। কিন্তু পরবর্তীতে বারবার তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে এবং তার মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে সাক্ষাৎকারের বিষয়ে জানালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) ইফতে খায়ের আলম বলেন, ‘বিষয়টি গোদাগাড়ী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপারের তদন্তাধীনে রয়েছে। এ বিষয়ে তিনিই ভালো জানাতে পারবেন।’

জানতে চাইলে গোদাগাড়ী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘ভূক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার উভয়পক্ষকে নিয়ে সার্কেল অফিসে একটি আলোচনায় বসা হয়েছিল। এসআই আনিসের স্ত্রী লিখিত একটি অভিযোগ ওই দিনই দাখিল করেছেন। তবে এসআই আনিস তার পক্ষ থেকে কিছু সময় চেয়েছেন। বিষয়টি বিভাগীয় পর্যায়ের হওয়ায় তদন্তাধীন রয়েছে। নিরপেক্ষ তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

সূত্রঃ দৈনিক আমাদের সময়

ad

পাঠকের মতামত