344341

যেসব কারণে পরাশক্তি হওয়ার যোগ্য নয় ভারত

ভারতীয় রাজনৈতিক নেতা ও শীর্ষ আমলাদের বিশ্বে তাদের দেশের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা সম্ভবত বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। এসব এলিট সংবিধানে থাকা প্রজাতন্ত্রের মৌলিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন নন। মনে হচ্ছে, তারা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে দৃশ্যত ভুলে গেছে। অথচ, তারা তাদের অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, রাজনৈতিক, সামরিক ও কৌশলগত সক্ষমতার বাইরে থাকা বিশাল দায়িত্ব নিতে চান।

ভারত সম্পর্কে দুটি গ্রন্থ ও তিনটি প্রতিবেদনে পড়ে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। প্রথমটি হলো এস জয়শঙ্করের লেখা ছোট্ট গ্রন্থ : The India Way: Strategies for an Uncertain World। তিনি চার দশকেরও বেশি ভারতের পররাষ্ট্র বিভাগে কাজ করেছেন। তিনি ২০১৯ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় মেয়াদে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। মোদি তাকে ২০১৫ সালে পররাষ্ট্রসচিব করেছিলেন তার যুক্তরাষ্ট্রমুখী পররাষ্ট্রনীতির চিন্তাভাবনার কারণে।

জয়শঙ্কর তার গ্রন্থে বলেছেন, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ইতিহাস থেকে তিনটি বোঝা বহন করে। তিনি লিখেছেন :

একটি হলো ১৯৪৭ সালের বিভক্তি। এট দেশকে জনসংখ্যাগত ও রাজনৈতিকভাবে খর্ব করেছে। এটি অকল্পনীয়ভাবে এশিয়ায় চীনকে আরো বেশি কৌশলগত সুবিধা দিয়ে দিয়েছে। আরেকটি হলো বিলম্বিত অর্থনৈতিক সংস্কার। এটি গ্রহণ করা হয়েছিল চীনের দেড় দশক পর। এবং অনেক বেশি বৈপরত্যপূর্ণভাবে। ১৫ বছরের ব্যবধান ভারতকে অনেক বেশি অসুবিধায় ফেলে দিয়েছে। তৃতীয় হলো, পরমাণু বিকল্প প্রয়োগে দীর্ঘায়িত অনুশীলন।

তিনি লিখেছেন, এর ফলে ভারতকে এমন এক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রবলভাবে সংগ্রাম করতে হচ্ছে, যা এর আগে অনেক সহজ ছিল। অবশ্য, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়,কোনা কালেই না করার চেয়ে দেরিতে করাও অনেক ভালো। তবে ১৯৪৭ সালের পর থেকে আমাদের ভুলগুলো নিয়ে আত্ম-সমালোচনা অবশ্যই জাতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে।

তিনি চীনের ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক শক্তির সাথে ভারসাম্য পুনঃস্থাপনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোট করার জন্য ঝুঁকি গ্রহণের পক্ষেই কথা বলেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অংশীদারিত্ব গড়ার মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে ভারত অনেক বেশি লাভবান হতে পারবে।

দ্বিতীয় গ্রন্থটি হলো,শ্যম শরনের How India Sees the World: Kautilya to the 21st Century।শরন ২০০৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ভারতের পররাষ্ট্রসচিব ছিলেন। শরন লিখেছেন,প্রধান প্রতিপক্ষের সাথে ভারসাম্য বিধানের জন্য অন্য শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর সাথে ভারতকে অবশ্যই জোট গঠন করতে হবে। এর মানে হলো যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে।এ সব দেশের এশিয়ায় ক্ষমতার চীনা আগ্রাসন প্রশ্ন ভারতের উদ্বেগের সাথে একমত।

এই দুটি বই থেকে যে উপসংহারে আসা যায় তা হলো, এসব সিনিয়র পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক ব্যক্তিত্ব মনে হচ্ছে চীনের অর্থনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নিয়ে অতিমাত্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। অবশ্য বিশ্বেও তাদের দেশ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের বর্তমান অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করে না। চীনের প্রভাবের সাথে ভারসাম্য পুনঃস্থাপনের জন্য ভারতের অনুকূল সময় এখন নয়। চীনকে মোকাবেলার মতো অবস্থায় ভারত নেই। আমি বিশ্বাসযোগ্য আন্তর্জাতিক থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক ও মিডিয়ার তিনটি প্রতিবেদনও পড়েছি, চেষ্টা করেছি ভারতের বর্তমান অবস্থান নিয়ে কাজ করতে।

প্রথমত, গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স ১৬ অক্টোবর যৌথভাবে প্রকাশ করেছে কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ও ওয়েলথহাঙ্গারলাইফ। এতে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সূচক ব্যবহার করা হয়েছে।
ভারতীয় কৌশলবিদেরা যদিও দাবি করেন যে ভারত হলো বৈশ্বিক শক্তির আকাঙ্ক্ষী, কিন্তু তা সত্ত্বেও যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় জিএইচআই র্যাং কিংয়ে তারা সবার নিচে রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১০৪টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ৯৪তম। ভারত রেড জোনে সুদানের সাথে একই অবস্থানে আছে। এর মানে হলো, ভারতের ক্ষুধা পরিস্থিতি আতঙ্কজনক শ্রেণিতে রয়েছে। ভারতের দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর অবস্থান হলো : শ্রীলঙ্কা ৬৪, নেপাল ৭৩, বাংলাদেশ ৭৫, পাকিস্তান ৮৮।

ভারত তার শিশুদের খাওয়াতে পারে না, অথচ বৈশ্বিক কৌশলগত খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
দ্বিতীয়ত, ব্লুমবার্গ বিজনেসে অ্যান্ডি মুখার্জির একটি প্রতিবেদন পড়েছি ১৭ অক্টোবর। এর শিরোনামটি অবাক করা : ‘পরবর্তী চীন? ভারতকে আগে অবশ্যই বাংলাদেশকে হারাতে হবে।‘

মুখার্জি লিখেছেন, ১৯৯০-এর দশকে অর্থনীতি উন্মুক্তকরণ শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতের স্বপ্ন ছিল চীনের দ্রুত সম্প্রসারণকে অনুকরণ করা। তিন দশকের প্রচারণার পর বাংলাদেশের চেয়ে পেছনে পড়ে ভারতের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশ্চাত্য চায় চীনের বিরুদ্ধে অর্থপূর্ণ ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ওই অংশীদারিত্ব নিম্ন-মধ্য আয়ের ফাঁদে ভারতের আটকে পড়ার ভবিষ্যদ্বাণী তাতে করা হয়নি। তৃতীয় যে প্রতিবেদন থেকে আমি তথ্য সংগ্রহ করেছি, তা অনেক প্রকাশিত হলেও এখনো তা প্রাসঙ্গিক। ডাভোসভিত্তিক ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৭ সালের ওয়ার্ল্ড ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট (আইডিআই) রিপোর্টে তা প্রকাশিত হয়েছিল।

এতে বলা হয়েছে, আইডিআই হলো জিডিপির বিকল্প, এর মাধ্যমে জনগণ তাদের দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি মূল্যায়ন করতে পারে। ২০১৮ সালের আইডিআই র্যাং কিংয়ে বলা হয়েছে, ভারত আবারো তলানিতে যাচ্ছে। ইমার্জিং ইকোনমিস শ্রেণির ৭৪টি দেশের মধ্যে নেপালের র্যাং কিং ২২, বাংলাদেশের ৩৪, শ্রীলঙ্কার ৪০, পাকিস্তানের ৪৭ ও ভারতের ৬২। ভারত বৃহত্তম কার্যকর গণতান্ত্রিক দেশ হলেও সে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের রোল মডেল হতে পারে না, এমনকি মানবাধিকার রেকর্ডেও না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সম্প্রতি ভারতে তার অফিস বন্ধ করার মধ্যেও তা প্রতিফলিত হচ্ছে।

এসব প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভারত না ঐতিহ্যবাহী পরামক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুলনীয়, না উদীয়মান পরাশক্তি চীনের সাথে তুলনীয়। সে জাপান বা জার্মানির মতো মধ্য শক্তির দেশের সাথেও তুলনীয় নয়। সে এমনকি অনেক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের মতো নিকট প্রতিবেশীরও সমকক্ষ নয়।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিযোগীদের চেয়ে ভারত পিছিয়ে আছে। ফলে ভারত তার অর্থনৈতিক দক্ষতা বা আর্থসামাজিক উন্নয়নের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের রোল মডেল নয়। ভারতের খারাপ ভাবমূর্তির কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের দিকে না তাকিয়ে চীনের দিকে তাকাচ্ছে।নিম্নতর আর্থসামাজিক উন্নয়ন র্যাং কিংয়ের কোনো দেশ উচ্চতর র্যাং কিংয়ে থাকা দেশের রোল মডেল হতে পারে না।

ভারতীয় নেতা ও আমলাদের প্রত্যাখ্যান ভারতের জন্য কাজ করছে না। ভারত যত তাড়াতাড়ি স্বীকার করবে যে সে পরাশক্তি, মধ্য শক্তির দেশ ও নিকট প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে, ভারতের পক্ষে তত সহজ হবে তার অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধানের কাজ শুরু করা। বৈশ্বিক খেলোয়াড়র হওয়ার দম্ভ ভারতীয় নেতা ও কর্মকর্তাদের জন্য দরকারি হতে পারে, কিন্তু তা জনগণের কোনো কাজে লাগে না।

ভারতকে অবশ্যই কোয়াড, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি, মালাবার ড্রিলের মতো কৌশলগত ম্যাট্রিক্সের কা কা রব বন্ধ করতে হবে। কারণ এসব জিনিস ভারতীয় শিশুদের ভয়াবহ ক্ষুধা সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না। এগুলো ভারতের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও সহায়ক হবে না। ভারতকে প্রথমে অবশ্যই ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি গড়তে হবে। তারপর বৈশ্বিক সম্প্রদায় তাকে বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে স্বীকৃতি দেবে।

সূত্র : এশিয়া টাইমস

ad

পাঠকের মতামত