338695

বাড়ি ফিরছে নয়নের লা’শ, অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া দেওয়ার পয়সাও নেই বাবার হাতে

দিনমজুর মেহের আলীর বড় ছে’লে মো. শুকুর আলী নয়ন (২৭)। ভিটেমাটি কিছুই ছিল না তাদের। মা-বাবা, ছোট দুই ভাই এবং একমাত্র বোনকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে চলে গিয়ে সেখানে মডেল গার্মেন্টস নামে একটি গার্মেন্টসে কাজ করতেন। সেখানে থেকে ক’ষ্টার্জিত সঞ্চয়ে এলাকায় জায়গা কিনে বাড়ি করে মা-বাবা ভাইদের এলাকায় ফেরত পাঠিয়েছেন। বোনের বিয়ে দিয়েছেন।

আরও কিছুদিন কাজ করে আরেকটু সঞ্চয় হলে এলাকায় ফিরে কিছু করার ইচ্ছে ছিল তার। বিয়ে করে এলাকাতেই থিতু হওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু, গত শুক্রবার নারায়ণগঞ্জের ম’সজিদে এসি বি’স্ফোরিত হয়ে তার সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেলো।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতা’লে রাখা লা’শের সারিতে পাওয়া গেলো লালমনিরহাটের আদিতমা’রী উপজে’লার পলা’শী ইউনিয়নের তালুক পলা’শী এলাকার শুকুর আলী নয়নেরও পোড়া দেহ। নয়ন বাড়ি ফিরলেন ঠিকই কিন্তু লা’শ হয়ে।

এক বছর আগে নিজ জে’লা লালমনিরহাট আদিতমা’রী উপজে’লার পলা’শী ইউনিয়নের তালুক পলা’শী এলাকায় একদোন জমি কিনে বাড়ি করেন তারা। এলাকায় বোন বৃষ্টি বেগমের বিয়ে দেন। নতুন বাড়িতে মাস চারেক আগে মা- বাবা, ভাই-বোনদের পাঠিয়ে দেন। নিজে থেকে যান নারায়ণগঞ্জেই। আর কিছুদিন গার্মেন্টে কাজ করে ঘর-দোর সাজ-গোজ করে এলাকায় ফিরে বিয়ে করার পরিকল্পনা ছিল নয়নের। বউ নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা ছিল। এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য বা কিছু একটা করার কথা ছিল। কিন্তু সেসব আশা পূরণ হলো না। নয়ন বাড়ি ফিরেছে ঠিকই কিন্তু লা’শ হয়ে। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছে তার জীবনের গল্প এভাবেই তুলে ধরেন আহাজারিরত নয়নের স্বজনরা।

শনিবার দিবাগত রাত ১২টায় মোবাইলে নয়নের বিষয়ে কথা হচ্ছিল তার বন্ধু শুভ শামীমের (২৩) সাথে। তখন তিনি এসব কথা বলতে বলতে কা’ন্নায় ভেঙে পড়েন। লা’শবাহী গাড়িতে বসেই কথা বলছিলেন তিনি। তার সামনের রাখা নয়নের লা’শ। রাত ১২টায় অ্যাম্বুলেন্সটি বগুড়া পৌঁছেছে বলে জানান শুভ। তিনি জানান, এ গাড়িতে নয়নের মা ও ভগ্নিপতি আছে। কিন্তু তারা কাঁ;দতে কাঁদতে ক্লা;ন্ত হয়ে পড়েছেন।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শুভ শামীম বলেন, ‘শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় আমাদের গার্মেন্টস ছুটি হয়। নয়ন বাসায় ফিরে নামাজ পড়তে ম’সজিদে এসেছিল। নামাজ পড়ে সে ফিরলে আমাদের একসাথে রাতের খাবার খাওয়ার কথা। কিন্তু হঠাৎ শুনলাম বি’স্ফোরণ, ম’সজিদে আ’গুন লাগছে। গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। আম’রা ওই ম’সজিদের মেসেই থাকি। তাকে খোঁজাখুজি করে না পেয়ে অ’বাক হই, ভ’য় পেয়ে যাই।

ওখানে না পেয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতা’লে আসি। সেখানে ওর লা’শ ও মোবাইলটি পাই। এরপর ওর বাড়িতে কথা হয়। ওর ভগ্নিপতি ও মা শনিবার সকাল ৬টায় ঢাকায় পৌঁছালে লা’শ বুঝে পান। এরপর আম’রা ১৫ হাজার টাকায় একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে লা’শ নিয়ে রওনা দিয়েছি। কিন্তু লা’শবাহী গাড়ির টাকাও আমাদের হাতে নেই। যদি পারেন আপনারাও একটু সহযোগিতা করবেন। বিষয়টি দেখেন কী’ করা যায়।

নয়নের সহকর্মী শুভ শামীম আরও বলেন, ‘অনেক মেধাবী ও পরিপাটি ছিল নয়ন। ও স্যাম্পল সুপারভাইজার পদে কাজ করতো। সব সময় সুন্দর পোশাকে থাকার চেষ্টা করতো। সব শেষ তার পরনে যে টি-শার্টটি ছিল তাতে লেখা ছিল ‘নেভা’র গিভ আপ’-মানে কখনও হাল ছাড়বেন না। কিন্তু, আজ ঠিকই তাকে সংসারের হাল ছেড়ে ওপারে পাড়ি জমাতে হলো। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি যেন সে বেহেশত পায়।’

অ’পরদিকে, নয়নের গ্রামের বাড়ি আদিতমা’রী উপজে’লার পলা’শী ইউনিয়নের তালুক পলা’শী এলাকার প্রতিবেশী যুবক খাদিমুল ইস’লাম (৩০) বলেন, ‘ওদের ভিটেমাটি কিছুই ছিল না। ওরা সবাই নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্টে কাজ করত। কিছুদিন আগে বোনকে বিয়ে দিয়েছে। এলাকায় এক দোনের মতো জমি কিনে সেখানে নতুন কাঁচা একটি বাড়ি তৈরি করেছে।

সেখানে মা-বাবা ও দুই ভাইকে পাঠিয়েছে। কিছুদিন পর নয়নের আশা কথা ছিল। এরপর বিয়ে করে এলাকায় কিছু একটা করার কথা বলেছিল। কিন্তু তার আশা পূরণ হলো না। বাড়ি আসলো ঠিকই কিন্তু, লা’শ হয়ে। ঘটনাটি ম’র্মা’ন্তিক ও বেদনাদায়ক। রবিবার তার লা’শ দাফনের প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু নয়নের বাবা মেহের আলীর হাতে কোনও টাকায় পয়সা নাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘নয়নের লা’শ রবিবার সকাল ১০টার পর দাফন করার প্রস্তুতি চলছে।’নয়নের বাবা মেহের আলী, দুই ছে’লে ও মে’য়েসহ আত্মীয়-স্বজনদের আহাজারিতে আশপাশের পরিবেশ ভা’রি হয়ে ওঠে। প্রতিবেশীরা কেবল সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন তাদেরকে। লালমনিরহাট জে’লা প্রশাসক আবু জাফরের সঙ্গে রাত ১২টায় কথা হলে তিনি নয়নের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতার করার আশ্বা’স দিয়ে বলেন, এখন অনেক রাত হয়ে গেছে। রবিবার লা’শ আসার পর আম’রা জে’লা প্রশাসন ও আদিতমা’রী উপজে’লা প্রশাসনের মাধ্যমে যথাসাধ্য সহযোগিতার চেষ্টা করবো।

ad

পাঠকের মতামত