331378

বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি গ্রামবাসী, ১২ বছরের ছেলে নিয়ে শ্মশানে রাত কাটালেন মা

নিউজ ডেস্ক।। প্রা’ণঘাতী করোনা ভাইরাস সন্দেহে গ্রামবাসী ঘরে ঢুকতে দেননি। তাই, ১২ বছরের ছেলেকে নিয়ে শ্মশানে রাত কাটালেন দিল্লি-ফেরত এক মহিলা।

আর রাত জেগে মেয়ে ও নাতিকে পাহারা দিলেন মহিলার বৃদ্ধ বাবা। তারপর, শনিবার (১১ জুলাই) সারাদিন থানা-পুলিশ করে মেয়ে ও নাতিকে নিয়ে যখন ঘরে ঢুকলেন ওই বৃদ্ধ, তখন ঘড়ির কাঁটা তিনটে ছুঁইছুঁই।

শুনতে গল্পের মতো মনে হলেও বাস্তবে এমনই ঘটনা ঘটেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়ার রাজাপুরে।

ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর, বিয়ের পরে রঘুদেবপুর পঞ্চায়েতের পাঁচলা ডাকবাংলো এলাকার মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্বামীর সঙ্গে থাকতেন দিল্লিতে।

সেখানেই সোনারুপোর কাজ করতেন তাঁর স্বামী। বছর চারেক আগে স্বামীর মৃ’ত্যুর পরে আর শ্বশুরবাড়ি বাউড়িয়ায় ফিরতে চাননি মহুয়াদেবী। ছেলেকে নিয়ে থেকে গিয়েছিলেন দিল্লিতেই।

জরির কাজ শিখে যখন তিনি স্বনির্ভর হয়ে ওঠার লড়াই লড়ছেন, তখনই করোনা-হানায় বেসামাল হয় দেশ। শুরু হয় লকডাউন। কাজ হারান মহুয়াদেবী।

চার মাস কোনওরকমে কাটানোর পরে তিনি ঘরে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। শুক্রবার বেলা ১২টা নাগাদ পাঁচলা ডাকবাংলোয় নিজের গ্রামে ফেরেন মহুয়া। তখনও জানতেন না, বদলে গিয়েছে তাঁর গ্রাম।

মহুয়ার কথায়, ‘‘দু’বছর পরে বাড়ি ফেরার আনন্দে মনটা বেশ ফুরফুরে ছিল। কিন্তু এমন যে ঘটবে, তা কল্পনাতেও ছিল না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমাকে বাড়িতে ঢুকতে বাধা দেন কয়েকজন গ্রামবাসী।

বলেন, আমরা এখানে থাকলে করোনা ছড়াবে। আমি ও আমার বাবা ওঁদের অনেক অনুরোধ করি। কিন্তু ওঁরা কিছুতেই রাজি হয়নি।’’

মহুয়াদেবীর বাবা সুদর্শন পান্ডে বলেন, ‘‘আমি গ্রামবাসীকে কথা দিয়েছিলাম যে, ১৪দিন মেয়ে-নাতি বাড়িতেই থাকবে। তাতেও ওঁরা রাজি হননি।’’

সুদর্শনবাবুর আর একটি বাড়ি রয়েছে পাঁচলার সাহাপুরে। বেলা ৪টা নাগাদ মেয়ে-নাতিকে নিয়ে সেই বাড়িতে যান তিনি। অভিযোগ, সেখানেও হাজির হন স্থানীয় লোকজন।

তাঁরা দাবি করতে থাকেন, অবিলম্বে মহুয়াদেবী ও তাঁর ছেলেকে বাড়ি ছাড়তে হবে। অগত্যা, চাপের মুখে সেই বাড়িও ছাড়তে হয় তাঁদের।

সুদর্শনবাবুর কথায়, ‘‘কোথায় যাব, কিছু ভেবে উঠতে পারছিলাম না। রাস্তায় ঘুরতে থাকি আমরা। তারপর ঠিক করি, রঘুদেবপুর আগুনখালি শ্মশানেই কাটিয়ে দেব রাতটা। মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে সারারাত শ্মশানে কাটাই। সারারাত ওদের পাহারা দিয়েছি।’’

ভোরের আলো ফুটতেই মেয়ে-নাতিকে নিয়ে ঘরে ফেরার মরিয়া চেষ্টা শুরু করেন সুদর্শনবাবু। তাঁদের স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান তিনি।

সেখানে স্বাস্থ্যপরীক্ষার পরে চিকিৎসকেরা তাঁদের ১৪দিন গৃহ-নিভৃতবাসে থাকার পরামর্শ দেন। সেই নথি নিয়ে ফিরে আসেন গ্রামে। কিন্তু ফের তাঁদের গ্রামবাসীর বাধার মুখে পড়তে হয়।

হস্তক্ষেপ করেন স্থানীয় সিপিএম পঞ্চায়েত সদস্যা কেতকী রায়চৌধুরী। তাতেও কোনও ফল হয়নি। তিনি বলেন, ‘‘গ্রামের মানুষকে বুঝিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কথা শোনেনি।’’

রঘুদেবপুরের বাসিন্দা রাজু অধিকারী ও সন্টু পোড়ালের মতো অনেকেই মহুয়াদেবী ও তাঁর ছেলেকে ঘরে থাকতে না-দেওয়ার পক্ষে অনেক যুক্তি খাড়া করেন। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘দিল্লিতে করোনা-আ’ক্রান্তের সংখ্যা অনেক।

সেখান থেকেই এসেছেন ওঁরা। ওঁর বাবার বাড়িতে একটি মাত্র ঘর। আলাদা শৌচাগার নেই। পাড়ায় একটি মাত্র পুকুর। ওই মহিলা পুকুরটি ব্যবহার করবেন। তাতে গ্রামে রোগ ছড়িয়ে পড়বে। তাই ওঁকে গ্রামে থাকতে বাধা দেওয়া হয়েছে।’’

মহুয়াদেবী বলেন, ‘‘দিল্লি ছাড়ার আগে আমাদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা হয়েছিল। করোনা সংক্রমণ মেলেনি। সেই রিপোর্টও দেখিয়েছিলাম। গ্রামের লোকজন তাতেও মানতে চায়নি।’’

পরে খবর পেয়ে এদিন দুপুরে এলাকায় যায় পুলিশ। বাসিন্দাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়। প্রায় তিন ঘণ্টা আলোচনার পরে তাঁরা মহুয়াদেবী ও তাঁর ছেলেকে ঘরে ঢুকতে দিতে রাজি হন।

মহুয়াদেবীর আক্ষেপ, ‘‘যেখানে ছোট থেকে বড় হয়েছি, যাদের সঙ্গে খেলা করেছি, তারাই আমাকে গ্রামে ঢুকতে বাধা দিয়েছে। এটা আমার কাছে লজ্জার।’’

সুদর্শনবাবু বলেন, ‘‘লকডাউনের জন্য মেয়ের রোজগার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই আমি ওকে চলে আসতে বলেছিলাম। যা হয়েছে, তা আমার কাছেও লজ্জার।’’

ad

পাঠকের মতামত