320745

দুঃস্বপ্নময় একটি দিন পার করেছি আজ!

মেহের আফরোজ শাওন।। বারে বারে নিজেকে জিজ্ঞেস করছি- ‘আসলেই কি বেঁচে আছি?’ দুইপুত্রকে বুকে জড়িয়ে তাদের ঘ্রাণ নিচ্ছি। বড়পুত্র একটু পর পর কেঁপে উঠছে। আর ছোটজন শক্ত থাকবার নিখুঁত এক অভিনয় করে যাচ্ছে! দুপুরের দিকে বড়জন বললো-

“তুমি পাশের বিল্ডিং এর লোকটাকে মই আনতে বলেছিলে কেন মা? তুমি কি ভাবছিলে মইয়ে করে আমাদের ছাদ থেকে ঐ বিল্ডিং এর ছাদে চলে যাব আমরা? কিন্তু ঐ বিল্ডিংটার সাথে তো অনেক গ্যাপ! কীভাবে যেতাম আমরা! সবাই পারলেও তুমি আর আমি তো পারতাম না! আমাদের না এ্যাক্রোফোবিয়া!”

আমি নিজেও নিশ্চিত না যে ঠিক কি ভেবে ৭/৮ ফুট দূরত্বের অন্য একটি ভবনের ছাদে পার হয়ে আগুনের হাত থেকে বাঁচব এমন চিন্তা মাথায় এসেছিল আমার!
ফ্ল্যাশব্যাকে আজ দিনের শুরুতে যাই। সকাল ৮ টায় ক্রমাগত কলিংবেল আর দরজায় সজোর ধাক্কার শব্দে ঘুম ভাঙতেই শুনলাম দখিন হাওয়ায় আমাদের বসবাসের ফ্ল্যাটটার তৃতীয় তলায় আগুন ধরেছে। সবাইকে নিচতলায় নেমে ভবনের বাইরে যেতে বলা হলো। আমি তড়িঘড়ি করে পুত্রদ্বয়ের ঘুম ভাঙিয়ে আগুনের কথা বললাম। তারপর বাসায় সাহায্যকারী মেয়ে লাভলী আর তার কন্যা আঁখিসহ আমরা সবাই ৬ তলা থেকে নিচে নামার প্রস্তুতি নিলাম। আমাদের পরনে ঘুমের পোশাক, নিনিত হাতের সামনে পেয়ে স্কুলের জুতা পরেই রওনা হলো। নিষাদের কোলে তার প্রিয় পোষা কুকুর ‘Penny’।

স্যান্ডেল পরার কথাও মনে নেই তার! দরজা খুলে বের হতেই একরাশ কালো ধোঁয়া আমাদের ঘিরে ফেলল। আমি পরনের ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে নিলাম, বাকিদেরকেও হাত কিংবা টিস্যু দিয়ে মুখ ঢেকে নিতে বললাম। আমাদের বাস ৬ তলায়- নামতে হবে ১২০ সিঁড়ি! কিন্তু ১০ খানা সিঁড়িও পেরোতে পারছি না! ৩ তলার ফ্ল্যাটে সূত্রপাত হওয়া আগুনের গরম হলকা এসে গায়ে লাগছে! আগুনের কারণে সৃষ্ট কার্বন মনোক্সাইড শ্বাসনালী চেপে ধরে রেখেছে! আর অপ্রতিরোধ্য কালো ধোঁয়া চোখে জ্বলুনি ধরিয়ে দিচ্ছে! প্রতিবেশি স্বর্না ভাবী, মাজহার ভাই আর তাদের দুইপুত্রও সিঁড়ি পেরিয়ে নিচে নামার চেষ্টায়। কিন্তু তারাও নিরুপায়! স্বর্না ভাবীর বড়পুত্র অমিয় প্রথম বলে উঠল-

“নিচে নামা অসম্ভব বুব্বুচাচী!” (এই অদ্ভুত নামে আমাকে ডাকার কারণটা আরেকদিন লিখব)
আমি বললাম- “ছাদে যাব?”
কাকে জিজ্ঞেস করলাম জানি না।
উত্তরের আশাও করিনি।

রওনা হলাম ছাদে। আমরা ২ পরিবার। ২০টি সিঁড়ি পেরোলেই ছাদ। আচ্ছা, ছাদে যাবার দরজা তো সারারাত বন্ধ থাকার পর বেলা করে খোলা হয়! আমরা ছাদের দরজা খোলা পাবো তো?

ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বোধহয়। তালা খোলাই পেলাম। ছাদে বেরিয়েই একটু বাতাস পেল ফুসফুস। নিজেকে সামলে নিয়ে ৯৯৯ এ ফোন দিয়ে জানলাম, খবর তারা আগেই পেয়েছে। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি রওনাও হয়ে গেছে। তারপর আমাদের অস্থির অপেক্ষা আর পায়চারি। ছাদের খোলা দরজা দিয়ে ভুরভুর করে কুচকুচে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে আকাশটাকে একটু একটু করে ঢেকে দিচ্ছে। আশপাশের ২/৩ টা ভবনের ছাদে জড়ো হয়েছেন কেউ কেউ। নিচের তলায় আগুনের কি অবস্থা জানবার কোনো উপায় নেই! শুধু আগুন নেভানোর চেষ্টায় দখিন হাওয়ার কর্মচারীদের চিৎকার আর দরজা দিয়ে ক্রমাগত বেরোতে থাকা কালো ধোঁয়া! হঠাৎ আতঙ্কে আমার মাথা ঘুরে উঠলো।

আগুন যদি পুরো ভবনে ছড়াতে শুরু করে তবে তো উপরের দিকেও আসবে! তখন! কি করবো আমরা! চোখের সামনে আগুনের খেলা দেখবো! পশ্চিম দিকের ভবনের ছাদটাই সবচে কাছের মনে হলো। কোনোভাবে কি তাদের ছাদে পার হয়ে যাওয়া যায়! পাগলের মতো আমি আর স্বর্না ভাবী তাদের সাহায্য চাইলাম। তারা যেন কোনো একটা মইয়ের ব্যবস্থা করেন! এদিকে মাজহার ভাই ফায়ার ব্রিগেডের আগমন ত্বরান্বিত করার জন্য ফোনে ব্যস্ত। বাচ্চাগুলো অসহায়ের মতো তাকাচ্ছে। আর আমাদের দুই বাসার সাহায্যকারী মেয়ে দু’টি যেন হাল ছেড়ে দিয়ে মাটিতে বসে পড়েছে! মই চলে আসলো। বারবার ফোনে চেষ্টা করেও দখিন হাওয়ার কোনো কর্মচারীর সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। জানতে পারছি না সে মুহূর্তে আগুনের কি অবস্থা! একবার পাশের ছাদের মইয়ের দিকে তাকাচ্ছি আরেকবার নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বদল করছি!

হঠাৎ সাইরেনের আওয়াজ শোনা গেল। কাছাকাছি এগিয়ে আসছে আওয়াজটা। দখিন হাওয়ার এক কর্মচারী ফোনে জানালো ফায়ার ব্রিগেডের লোকজন ভবনে ঢুকে পড়েছে। যে ফ্ল্যাটে আগুন লেগেছে তার নিচতলার বাসার ভদ্রলোক নাকি নিজের নিরাপত্তার কথা ভুলে দখিন হাওয়ার সাধারণ কর্মচারীদের সাথে হাত লাগিয়ে আগুন প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন। এদিকে ফেসবুকে আমার পোস্ট থেকে আগুন লাগার খবর জেনে পরিচিত অপরিচিত শুভাকাঙ্খীরা শুভকামনা আর সাহস দিয়ে যাচ্ছেন।

দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি কালো ধোঁয়া ধূসর হতে শুরু করেছে। একটু একটু করে স্বচ্ছ হচ্ছে আকাশ। রোদের খেলা শুরু হয়েছে দখিন হাওয়ার ছাদবাগানে।

[ফায়ার ব্রিগেডের লোকজন কাজ শুরু করবার আগেই আগুন সম্পূর্ন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে দখিন হাওয়ার সাধারণ কর্মচারীরা। ২এফ এর বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা লিটন সাহেবকে অশেষ ধন্যবাদ সঙ্গে থেকে কর্মচারীদের কাজে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় কোনো মানুষের শারীরিক ক্ষতি হয়নি এই অগ্নিকাণ্ডে। তবে বহুদিন হয়তো এই আগুনের আতঙ্ক বয়ে বেড়াবো আমরা।

আর হ্যাঁ, প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে যে আগুনের সূত্রপাত তিনতলার ঐ ফ্ল্যাটের একমাত্র বাসিন্দার (যিনি একজন মানসিক রোগী) সিগারেট থেকে হয়েছে! আশ্চর্যের ব্যাপার- জানালায় ধোঁয়া দেখে দরজা ভেঙে ওনার বাড়িতে ঢুকে যখন বসার ঘরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা যায় তখন তিনি পাশের ঘরে দরজা বন্ধ করে গান শুনছিলেন!](ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

ad

পাঠকের মতামত