316515

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশের চিকিৎসকদের যে পরামর্শ দিলেন লন্ডন প্রবাসী ডাক্তার

নিউজ ডেস্ক।। করোনাভাইরাস আতঙ্কের মধ্যেই চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তাররা। করোনার এই যুদ্ধে সামনে থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। এবার নিজের সেই অভিজ্ঞতার কথাই শেয়ার করেছেন যুক্তরাজ্যের রয়েল লন্ডন হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শাহরিয়ার মো. সাদেক।

প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করে গতকাল বৃহস্পতিবার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি। দৈনিক আমাদের সময় অনলাইন পাঠকদের জন্য তার স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো-

‘আজ থেকে প্রায় আট সপ্তাহ আগে হঠাৎ আমার মেইল বক্সে একটা “Urgent” flagged মেইল দেখতে পাই। মেইলের সারমর্ম তাৎক্ষণিক জরুরি মিটিং। মিটিংয়ে উপস্থিত হয়ে বুঝতে পারলাম কেমন যেন একটা থমথমে অবস্থা। মিটিং পরিচালনা করছেন হাসপাতালের ডিভিশনাল ডিরেক্টর, যিনি একজন anaesthetist and intensivist। ভদ্রমহিলার বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। তাকে আমরা সবাই workoholic হিসেবে জানি। খুবই authoritative type এর মানুষ। মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন আমাদের chief executive officer (non clinical adminstrative chief)। ৩০ মিনিটের মিটিংয়ে তিনি (ডিভিশনাল ডাইরেক্টর) প্রথমে খুব সংক্ষিপ্ত একটা প্রেজেন্টেশন দিলেন যার সারমর্ম ছিল মূলত হাসপাতাল কিভাবে কোভিড-১৯ (covid-19) মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হবে এবং কী কী ব্যবস্থা জরুরিভাবে (immediately) গ্রহণ করা হবে। তিনি হাসপাতালে ১০ সদস্যের একটা কমান্ডহাব গঠন করেন। যার কাজ হবে এই পুরো হাসপাতালের কর্মকাণ্ড সমন্বয় করা।

সার্জিক্যাল ডিভিশন থেকে আমার ধূরন্ধর (!) কলিগরা আমাকে এই কমান্ডহাবে ঠেলে দেন। পুরো মিটিংয়ে আর কেউই খুব একটা কথা বলেনি। ওই সময় আমাদের হাসপাতালে কোনো কোভিড (covid) আক্রান্ত রোগী ছিল না। আমাদের তথ্য উপাত্ত দিয়ে বোঝানো হলো কি পরিস্থিতি আসন্ন। আরও বলা হলো কত দ্রুত হাসপাতাল ফুল কেপাসিটি absorb করবে, ক্রিটিক্যাল কেয়ার বেডের সংখ্যা কী পরিমাণ বৃদ্ধি করা হবে etc। উল্লেখ্য, ওই সময়টাতে ইউকের সবকিছু খুব স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট directive ছিল না। কিন্তু আমাদের হাসপাতালসহ লন্ডনের বেশিরভাগ হাসপাতাল ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। পুরো বিষয়টা আমার কাছে খুব বেমানান লাগছিল, মনে হচ্ছিল এত তোড়জোড়ের কি প্রয়োজন! (স্বভাবগত বাঙালি চিন্তা)।

এখানে বলে রাখি আমার হাসপাতালের বেড সংখ্যা প্রায় ৮৪৫, তার মধ্যে এডাল্ট ক্রিটিক্যাল কেয়ার বেডের সংখ্যা প্রায় ৫০ (ইনটেনসিভ কেয়ার এবং হাইডিপেন্ডন্সি ইউনিট মিলিয়ে )। আমাদের অপারেশন থিয়েটারের সংখ্যা প্রায় ২০টি। প্রত্যেক থিয়েটারে দুটি করে ভেন্টিলেটর আছে। গতকালকের হিসেব অনুযায়ী আমাদের হাসপাতালে কোভিড আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৭৩২ জন। এর মধ্যে ৬২২ জন ওয়ার্ডে এবং বাকি ১১০ জন আইসিইউতে। বলা বাহুল্য, শুধু মাত্র ৩টা থিয়েটার অ্যাকটিভ রেখে বাকি সবগুলো থিয়েটারের ভেন্টিলেটরগুলো ব্যবহর করে make shift ITU গঠন করা হয়েছে। গত ৪-৬ সপ্তাহে আমরা যেসব ইমার্জেন্সি measure নিয়েছি তা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরছি-

১. পুরো হাসপাতালের ওয়ার্ডসমূহকে কোভিড এবং নন-কোভিড জোনে ভাগ করা হয়। কোভিড উপসর্গ সম্পন্ন সকল রোগীদের কোভিড জোনে রাখা হয়। কোভিড ওয়ার্ডগুলোতে আবার দুই ধরনের bay arrange করা হয়। পজিটিভ পেশেন্টদের এফেক্টেড বেডে রাখা হয়। নেগেটিভ কিন্তু উপসর্গ সম্পন্ন রোগীদের ওই ওয়ার্ডের সাইডরুম বা আইশোলেসন বেডে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। পর্যায়ক্রমে বর্তমানে হালপাতালের প্রায় ৮০ শতাংশ capacity কোভিড জোনের অন্তর্ভুক্ত ।

২. সকল প্রকার elective clinical activity (যেমন আউট পেশেন্ট ক্লিনিক, সাধারণ নন ক্যানসার সার্জারি ও প্রসিডিওর) পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে energency life or limb saving intervention ছাড়া আর কোনো ইনটারভেনশনই করা হচ্ছে না। উল্লেখ্য, টেলিফোন কনসালটেশনের মাধ্যমে রোগীদের ফলোআপ বা নতুন আর্জেন্ট রেফারেল কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

৩. ক্যানসার চিকিৎসা লিমিটেড করা হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে শুধুমাত্র suitable candidate দের কেমোথেরাপি বা সার্জারির জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে (only if benifit outweighs the risk)। যেক্ষেত্রে সম্ভব সেক্ষেত্রে চিকিৎসা ৮-১০ সপ্তাহের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

৪. সকল ধরনের ফিজিশিয়ানস and allied specialists দের কোভিড চিকিৎসায় পদায়ন করা হচ্ছে। শুধুমাত্র skeleton service maintain করে সার্জিকেল trainee বা জুনিয়র গ্রেডদের মেডিক্যাল ওয়ার্ড বা ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে পদায়ন করা হচ্ছে। এইসব চিকিৎসকদের গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে প্রস্তুত করা হয়।

৫. অপারেশন থিয়েটার, এন্ডস্কপি, ওপিডি নার্সদের বেশীরভাগকেই ওয়ার্ড বা ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে ডিপ্লয় করা হয়েছে।

৬. কমান্ডহাব থেকে পুরো বিষয়টা সার্বক্ষণিকভাবে তদারকি করা হচ্ছে। 2tier rota system adopt করা হয়েছে। যাতে একজন অসুস্থ হলে আরেকজন সঙ্গে কভার করার জন্য প্রস্তুত থাকে।

৭. এই সব ব্যবস্থাকে আরও বেগবান করেছে বিভিন্ন প্রফেশনাল বডির প্রকাশিত গাইডলাইন্স। BSG, Royal college of surgeons/physician/anaesthetists, NMC সমূহ নিয়মিতভাবে গাইডলাইন্স পাবলিশ এবং আপডেট করে যাচ্ছে ।

৮. কমান্ডহাবের মাধ্যমে বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান; এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়ে ও প্রতিনিয়ত হাসপাতালের স্টাফদের অভাবনীয় সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে ঢুকলে এখন মনে হয় যুদ্ধ ক্ষেত্র। পরিস্থিতির ভয়াবহতা লিখে প্রকাশ করা যাবে না।

এখন আমি বাংলাদেশের চিকিৎসক, নার্স সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আমার কিছু ভাবনা শেয়ার করতে চাই। বাংলাদেশের জন্য এই মহামারি কী পরিমাণ বিপর্যয় (scale of disaster) ডেকে আনতে যাচ্ছে তা এদেশের রাজনীতিবিদ, প্রশাসন কর্তাদের ধারণার ঊর্ধ্বে। চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে আপনাদের পক্ষেই এই ভয়াবহতা আচ করা সম্ভব । এই যুদ্ধ শুধু আপনাদের দ্বারাই মোকাবিলা করা সম্ভব।

এই মুহূর্ত থেকে আপনারা আপনাদের প্রস্তুত করুন। সরকারি হাসপাতালের পরিচালক, ডিপার্টমেন্টাল হেডবৃন্দ বসে আপনাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করুন। প্রতিটি হাসপাতালে কোভিড জোন ডেভেলপ করেন যা প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের সিংহভাগ capacity occupy করবে। ধীরে ধীরে নন-ইমার্জেন্সি, ইলেকটিভ interventions, routine outpatient activities কমিয়ে আনুন। Capacity compromised হতে শুরু হলেই emergency only policy adopt করুন।

যারা বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, এনেস্থেটিস্ট, ইনটেনসিভিস্ট আছেন তারা সকল বিভাগের জুনিয়র, মিড লেভেল চিকিসকদের basic respiratory support প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করুন। নিজ নিজ হাসপাতালে যে সব যন্ত্রাংশ অকার্যকর অবস্থায় আছে সেগুলো মেরামত সাপেক্ষে কার্যকর করার চেষ্টা করুন। জরুরি জীবন রক্ষাকারী adjuncts/medicines stock assess করে যতটুকু সম্ভব বৃদ্ধি করার চেষ্টা করুন। বেসরকারি হাসপাতাল পরিচালনা, চিকিৎসার সঙ্গে অসংখ্য চিকিৎসক নিয়োজিত আছেন।

আপনারা সাধ্যমতো চেষ্টা করেন যাতে তারাও এই স্ট্রাকচারাল অ্যারেন্জমেন্ট ফলো করতে পারেন। বিভিন্ন সার্জিক্যাল, মেডিক্যাল সোসাইটি সমূহ এ ব্যাপারে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিসিপিএস বাংলাদেশের কনটেক্সটে বিভিন্ন গাইডলাইন্স প্রকাশ করতে পারে যেটা উপেক্ষা করা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে রীতিমতো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এই মুহূর্তে এই প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে।

গত ২৪ ঘণ্টায় ইউকের মৃতের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার। এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকে তা এখনো ধারণাতীত। আজ বাংলাদেশ যে অবস্থানে আছে ঠিক চার সপ্তাহ আগে ইউকে সেই অবস্থায় ছিল। এই সহজ হিসেব করলেই বাংলাদেশের অবস্থা বুঝতে পারবেন। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা তথাকথিত রোগ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো not mature enough to deal with such situation।

তাদের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকলে এই ধ্বংসযজ্ঞ বহুগুণ বেড়ে যাবে। এই সব প্রতিষ্ঠান বা রাজনীতিবিদদের তুলোধোনা করে কোনো সমস্যারই বিন্দুমাত্র সমাধান হবে না। এই সব নামসর্বস্ব ব্যক্তিবর্গ বা প্রতিষ্ঠান থেকে আপনাদের সামর্থ্য অনেক অনেক অনেক বেশি। আপনারা আপনাদের কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে যেভাবে এই ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আগলে রেখেছেন তা সত্যিকার অর্থেই এক দানবীয় প্রচেষ্টা। এই ভয়ংকর সময়ে আপনারা হেরে গেলে এই দেশ আর কখনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। যে যার যার অবস্থানে থেকে যতটা সম্ভব প্রস্তুতি নেওয়ার চেষ্টা করুন। অন্যান্য সকলকে আমার অনুরোধ, আপনারা যে যেভাবে পারেন সকল হাসপাতাল, চিকিৎসক এবং নার্সদের সাহায্যে এগিয়ে আসুন। আগামী ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে প্রচুর সাহায্যের প্রয়োজন হবে। এই যোদ্ধাদের যুদ্ধ করার জন্য যা প্রয়োজন তার সিকিভাগও সরকারের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। আপনাদের সাহায্য ছাড়া এই সুনামি কোনোভাবেই মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

ব্রিটেন, স্পেন, ইতালির কথা চিন্তা করুন। অসহায় বিপর্যস্ত। অসংখ্য মর্গ আর কবরস্থান প্রিপেয়ার করা হচ্ছে। এই ভয়ংকর অবস্থায়ও মনকে চাঙ্গা করার মতো কিছু খবর শুনি। ব্রিটিশ সরকারের আহ্বানে ২০ সহস্রাধিক অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও নার্স আবারও কাজে ফেরার জন্য রেজিস্ট্রার করেছেন। সরকার আড়াই লাখ এনএইচএস ভলান্টিয়ারের জন্য আহ্বান করেছিল। তার বিপরীতে প্রায় ৮ লক্ষাধিক লোক আবেদন করেছে। এই যুদ্ধকে আমাদের সবাইকে মিলে মোকাবিলা করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দ্বারাই এই মহাপ্রলয় থামানো সম্ভব।’

ডা. শাহরিয়ার মো. সাদেক,
কনসালটেন্ট সার্জন,
রয়েল লন্ডন হাসপাতাল,
লন্ডন, যুক্তরাজ্য।

COVID 19 প্রিপারেশন এবং আমার অভিজ্ঞতাঃরয়েল লন্ডন হাসপাতাল , লন্ডন , ইউকে আজ থেকে প্রায় ৮ সপ্তাহ আগে হঠাৎ আমার মেইল…

Posted by Shahriar Sadek on Wednesday, 8 April 2020

ad

পাঠকের মতামত