315142

পদ্মাসেতু স্বপ্নের শেষ সিঁড়িতে

নিউজ ডেস্ক।। এক সময়ের স্বপ্ন ছিল পদ্মাসেতু। কিন্তু স্বপ্নের সেই সেতুতে যানবাহন উঠতে আর বেশি দিন বাকি নেই। এরইমধ্যে ৪২টি খুঁটির সবগুলোর কাজ শেষ হয়েছে। ৪১টি স্প্যানের মধ্যে ১৪টি স্প্যান বসানো বাকি রয়েছে। যা আগস্টে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এরপর থেকেই শুরু হবে সেতু ছুঁয়ে দেখার অপেক্ষা। মঙ্গলবার দুপুরে সেতুর শেষ পিলারের (পি-২৬) ঢালাই করা হয়। রাত ১০টার দিকে ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়। মহামারি আকারে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের কারণে দেশি-বিদেশি কর্মীদের একটি বড় অংশ ছুটিতে থাকলেও চলছে পদ্মা সেতুর কাজ। করোনা আতঙ্কের মধ্যেই শেষ হয়েছে ৪২টি পিলারের সবকটির কাজ। পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক দেওয়ান মো. আবদুল কাদের এ তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি জানান, পদ্মা সেতুর ৪২টি খুঁটির সবগুলো নির্মাণ কাজ শেষ হলেও বাকি রয়েছে কেবল ১৪টি স্প্যান ওঠানো। এরপর স্প্যানের ভেতরে রেলপথ ও ওপরের সড়কপথ বিস্তৃত করার কাজ চলবে। মঙ্গলবার (৩১ মার্চ) দুপুর সাড়ে ১২টায় পদ্মা সেতুর সবশেষ খুঁটির ওপরের অংশের ঢালাই কংক্রিটিং শুরু করা হয়।

সেতু প্রকৌশলীরা জানান, সন্ধ্যার মধ্যে এ কংক্রিটের কাজ শেষ হবে। এরপর আরও তিন দিনের মধ্যে এটি শক্ত আকার ধারণ করবে। আর প্রায় এক মাসের মধ্যে পুরোপুরি লোড নেওয়ার ক্ষমতা পাবে এ খুঁটি।

প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে চলা পদ্মা সেতুর খুঁটির কাজ শেষের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করল প্রকল্প। মাঝখানে শুধুমাত্র খুঁটি জটিলতার কারণে কাজ পিছিয়েছে এক বছরের বেশি সময়। নদী তলদেশের মাটির গুণগত বৈশিষ্ট্য বদলে খুঁটি গেঁথেছেন সেতুর প্রকৌশলী ও নির্মাণ শ্রমিকরা। এদিকে পদ্মা সেতুর ৪১টি স্প্যানের ২৭টি এ পর্যন্ত বসানো হয়েছে। বাকি রয়েছে মাত্র ১৪টি স্প্যান বসানো। যা শেষ হবে আগস্ট মাসে।

চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি জানায়, মূল সেতুর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে মাওয়া এসেছে ৩৯টি। ২৭টি স্থাপন করা হয়েছে। যার দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ৫০ মিটার। অবশিষ্ট ২টি স্প্যান চীনে নির্মাণ সম্পন্ন করে রাখা। এখন সে দু‘টির ব্লাস্টিং ও পেইন্টিং কাজ চলছে। আগামী ২০ এপ্রিলের মধ্যে চীন থেকে এটি বাংলাদেশে রওনা দেবে। এরপরই পুরো সেতু একসঙ্গে দৃশ্যমান হবে।

৪২টি খুঁটিতেই দাঁড়াবে ৬.১৫ কিলোমিটার লম্বা পদ্মাসেতু। এক খুঁটি থেকে আরেক খুঁটির দূরত্ব প্রায় ১৫০ মিটার। একেকটি খুঁটি ৫০ হাজার টন লোড নিতে সক্ষম।

পদ্মা সেতুর প্রকৌশলীরা জানান, মাঝনদী ও মাওয়া প্রান্তে পদ্মাসেতুর ২২টি খুঁটিতে সবচেয়ে বেশি জটিলতা দেখা দিয়েছিল। প্রথমদিকে যে গভীরতার ধারণা নিয়ে কাজ এগোনে হচ্ছিল বাস্তবে তার সঙ্গে মিলেনি। এ নিয়েই বিপত্তি হয়েছিল সেতু নির্মাণে।এসব কারণে আটকে যায় ২২টি পিলারের কাজ। সবশেষে এমন একটি পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় যাতে নদীর তলদেশে কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় মাটি বদলে নতুন মাটি তৈরি করে পিলার গাঁথা যায়। এই বিশেষ ‘স্ক্রিন গ্রাউটিং’ পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা সফলতা পাওয়া যায়। পদ্মা সেতুর আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল প্রধান অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী জানান, পাইপের ছিদ্র দিয়ে বিশেষ কেমিক্যাল নদীর তলদেশে পাঠিয়ে মাটির গুণাগুণ শক্ত করে তারপর সেখানে খুঁটি গাঁথা হয়েছে।

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ‘কাজ শুরু করতে গিয়ে নদীর নিচে মাটির যে স্তর পাওয়া গেছে তা পিলার গেঁথে রাখার উপযোগী নয়। পরে নদীর তলদেশের মাটির গুণগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে ড্রাইভিং করতে হয়েছে। এমন পদ্ধতিতে কোনো সেতুর খুঁটি নির্মাণ বাংলাদেশে প্রথমবারের মত এবং বিশ্বে নজিরবিহীন।’

পদ্ধতিটি ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘পাইলের সঙ্গে স্টিলের ছোট ছোট পাইপ ওয়েল্ডিং করে দেওয়া হয়েছে। আর পাইপের ভেতর দিয়ে এক ধরনের কেমিক্যাল পাঠিয়ে দেওয়া হয় নদীর তলদেশের মাটিতে। আর তখন সেই মাটি শক্ত রূপ ধারণ করে। এরপর এসব পাইল লোড বহনের সক্ষমতা তৈরি হয়। আর এ পদ্ধতিটির নাম স্কিন গ্রাউটিং।’ পদ্মা সেতু প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১১টি খুঁটি গড়ে তোলা হয়েছে। সবশেষ ৪২ নাম্বার খুঁটি এভাবে সম্পন্ন করা হলো। যা এখন কংক্রিটিংয়ের মাধ্যমে শেষ হচ্ছে।

নদীতে ৬.১৫ কিলোমিটারসহ তিন জেলা মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর মিলিয়ে সাড়ে ৯ কিলোমিটার লম্বা পদ্মাসেতু। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এই নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী বছর জুনে পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হবে। তখন একসঙ্গে সড়ক ও রেলপথে চালু হবে। এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতু চার কিলোমিটার দৃশ্যমান।

পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম জানান, মূল সেতুর বাস্তব কাজের অগ্রগতি-৮৬.৭৫ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি- ৮৩.৯৭ শতাংশ। মূল সেতু কাজের চুক্তিমূল্য- ১২ হাজার ১৩৩.৩৯ কোটি টাকা এবং এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ১৮৮.০৭ কোটি টাকা। ।

নদীশাসন কাজের বাস্তব অগ্রগতি-৭০.৫০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি- ৫৫.০৫ শতাংশ। নদীশাসন কাজের চুক্তিমূল্য- ৮ হাজার ৭০৭.৮১ কোটি টাকা এবং এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে- ৪ হাজার ৭৯৩.৯০ কোটি টাকা। সংযাগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়ার বাস্তব কাজের অগ্রগতি ১০০ শতাংশ। মূল সেতুতে মোট ৪২টি এবং দুইপ্রান্তের ভায়াডাক্টে (৪৪+৪৭) ৯১টিসহ সর্বমোট ১৩৩টি পিয়ার রয়েছে। এখন সবগুলো পিয়ার বা খুঁটির কাজ শেষ হলো বলেও জানান প্রকল্প পরিচালক। উৎস: বাংলাদেশ টুডে।

ad

পাঠকের মতামত