312317

কেমন হবে জান্নাতি হুর

মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলামঃ আল্লাহ তাআলা মুমিনের জন্য তৈরি করে রেখেছেন চিরসুখের আবাসন—জান্নাত। এ জান্নাত কেমন, তার বর্ণনা আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে এবং বিশ্বনবী (সা.) হাদিসে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন।

জান্নাত কেমন

জান্নাত আরবি শব্দ। এর অর্থ উদ্যান, বাগান। মহানবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি আমার নেক বান্দাদের জন্য এমন সব নিয়ামত প্রস্তুত করে রেখেছি, যা কোনো চক্ষু দেখেনি, কোনো কান শোনেনি এবং কোনো মানুষের মনে এ সম্পর্কে কোনো ধারণাও জন্মেনি। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৯৯৪)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জান্নাতে মুমিনদের জন্য মোতির গাঁথুনি করা একটি তাঁবু আছে। এর উচ্চতা ৩০ মাইল। এর প্রত্যেক কোণে মুমিনদের জন্য এমন নারীরা থাকবে যাদের কেউ দেখেনি। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৯৯৩)

আনাস ইবন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জান্নাতে এমন একটি বৃক্ষ রয়েছে, কোনো সওয়ারি তার ছায়ায় এক শ বছর ধরে চললেও তা অতিক্রম করতে পারবে না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৯৯০)

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হে নবী! যারা ঈমান আনে এবং সত্কর্ম করে, তাদের সুখবর দিন, তাদের জন্য রয়েছে এমন জান্নাত, যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবহমান থাকবে। যখনই তাদের ফলমূল খেতে দেওয়া হবে, তারা বলবে, এরূপ ফলই তো আগে আমাদের দেওয়া হতো। তাদের বাহ্যিক দৃষ্টিতে একই ধরনের ফলমূল দেওয়া হবে (তবে স্বাদ হবে ভিন্ন)। আর সেখানে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্র সঙ্গী। তারা সেখানে অনন্তকাল বসবাস করবে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৫) জান্নাতে থাকবে চারটি নদী—একটি পানির, একটি মধুর, একটি দুধের এবং একটি শরাবের।

কেমন হবে জান্নাতিদের আকৃতি

মহানবী (সা.) বলেছেন, আমার ৭০ হাজার উম্মত একসঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদের চেহারা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৯৮৯)

আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জান্নাতে প্রবেশকারী প্রথম দলের চেহারা হবে ১৪ তারিখের চন্দ্রের মতো। জান্নাতে তাদের থুতু আসবে না। নাকে সর্দি ঝরবে না, মলত্যাগ করতে হবে না। তাদের ঘাম মেশকের মতো সুগন্ধিযুক্ত হবে। প্রত্যেকে দুজন করে এমন স্ত্রী পাবে, অত্যধিক সৌন্দর্যের কারণে তাদের মাংস ভেদ করে হাড়ের ভেতরের মজ্জাও দেখা যাবে। জান্নাতিদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেবে না। পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হবে না। সবাই এক মন, এক প্রাণ হয়ে থাকবে। সকাল-বিকাল তারা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণায় রত থাকবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৯৯৫)

প্রিয় নবী (সা.) আরো বলেন, জান্নাতিরা অসুস্থ হবে না, কখনো তাদের নাকে সর্দি ঝরবে না। থুতু আসবে না। তাদের বাসন হবে সোনা ও রুপার। চিরুনি হবে স্বর্ণনির্মিত। তাদের আংটিসমূহ মুক্তার মতো চিকচিক করতে থাকবে। (বুখারি, হাদিস : ২৯৯৬)

জান্নাতিরা হবে ৩৩ বছরের যুবক-যুবতি, দৈর্ঘ্যে হবে ৬০ হাত, জান্নাতিরা অতি উজ্জ্বল চেহারার অধিকারী। জান্নাতে যে ফলমূল দেওয়া হবে, তা দেখতে এক রকম হলেও স্বাদে-গন্ধে হবে ভিন্নতর ও বৈচিত্র্যময়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তারা পরিধান করবে চিকন ও পুরু রেশমি বস্ত্র এবং মুখোমুখি হয়ে (গদিতে) বসবে।’ (সুরা দোখান, আয়াত : ৫৩)

কেমন হবে জান্নাতি হুর

জান্নাতি রমণীদের কোরআনের ভাষায় বলা হয় ‘হুর’। এ শব্দটি কোরআন মাজিদের চারটি সুরায় ব্যবহূত হয়েছে।

প্রথমত, সুরা দোখানের ৫৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি তাদের আনতলোচনা স্ত্রী দেব।’

দ্বিতীয়ত, সুরা তুরের ২০ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা সারিবদ্ধ সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসবে। আমি তাদের আনতলোচনা হুরদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে দেব।’

তৃতীয়ত, সুরা আর রাহমানের ৭২ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘(জান্নাতিদের জন্য রয়েছে) তাঁবুতে অবস্থানকারিণী হুরগণ।’ চতুর্থত, সুরা ওয়াকেয়ার ২২ থেকে ৩৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তথায় (জান্নাতে থাকবে) আনতনয়না হুরগণ, যারা আবরণে রক্ষিত মোতির মতো। তারা যা কিছু করত তার পুরস্কারস্বরূপ। তারা তথায় (জান্নাতে) অবান্তর ও কোনো পাপবাক্য শুনবে না, শুনবে সালাম আর সালাম (শান্তি, শান্তি)। যারা ডান দিকের দল, কত ভাগ্যবান ডান দিকের দল। তারা থাকবে এমন উদ্যানে, যেখানে আছে কাঁটাবিহীন কুলবৃক্ষ এবং কাঁদি কাঁদি কলা এবং দীর্ঘ ছায়ায় আর সদা প্রবাহিত পানি ও প্রচুর ফলমূল, যা শেষ হওয়ার নয় এবং নিষিদ্ধও নয়। আর থাকবে সমুন্নত শয্যায়। আমি জান্নাতি হুরদের বিশেষরূপে সৃষ্টি করেছি। তাদের করেছি চিরকুমারী, কামিনী, সমবয়স্কা।’

কেমন হবে জান্নাতি হুরের দেহ

মহানবী (সা.) বলেছেন, জান্নাতি রমণীদের চার রঙে সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন—সাদা, হলদে, সবুজ ও লাল। তাদের দেহ জাফরান, মৃগনাভি, আম্বর ও কাফুর দ্বারা সৃষ্টি। তাদের চুল লবঙ্গ দ্বারা সৃষ্টি। পা থেকে হাঁটু পর্যন্ত সুগন্ধি জাফরানের দ্বারা সৃষ্টি। হাঁটু থেকে নাভি পর্যন্ত মৃগনাভির দ্বারা তৈরি, নাভি থেকে ঘাড় পর্যন্ত আম্বরের তৈরি, ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত কাফুরের তৈরি। যদি একজন রমণী পৃথিবীতে সামান্য থুতু নিক্ষেপ করত, তাহলে সমগ্র পৃথিবী সুঘ্রাণে মুখরিত হয়ে যেত, তাদের বক্ষের মধ্যে আল্লাহর নাম ও স্বামীর নাম লেখা থাকবে। প্রত্যেকের হাতে ১০টি করে স্বর্ণের কাঁকন থাকবে। প্রত্যেক আঙুলে থাকবে মুক্তার আংটি এবং উভয় চরণে থাকবে জহরতের নূপুর।

জান্নাত হলো মুমিনের চিরসুখের ঠিকানা। সেখানে সুখশান্তির অন্ত থাকবে না। সুখশান্তি ও আরাম-আয়েশের জন্য যা প্রদান করা প্রয়োজন তার সব কিছুই মুমিনদের জান্নাতে প্রদান করা হবে। স্বামী-স্ত্রী উভয় মুমিন হলে স্বামী তার দুনিয়ার স্ত্রী পাবে। অন্যথায় স্বামী মুমিন হলে তার জন্য অন্য স্ত্রীর ব্যবস্থা করা হবে। আর শুধু স্ত্রী মুমিন হলে তার জন্য সুখের যাবতীয় সুব্যবস্থা থাকবে। (দুররুন-নাসিহিন : ১/১০৬)

লেখক : প্রধান ফকীহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী

ad

পাঠকের মতামত