301316

যেখানে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ছেন মানুষ

দিনটি ছিল ২০১৩ সালের মার্চ মাস। অন্য দিনের মতো সবাই কর্মব্যস্ততার মধ্য দিয়েই দিন শুরু করে গ্রামবাসী। হঠাৎ করেই গ্রামের অনেক মানুষ একে একে ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করে। শুনতে কিছুটা অদ্ভুত মনে হলেও এটাই সত্যি। চলুন যেনে নেয়ে যাক সেই রহস্যময় গ্রাম সর্ম্পকে!

রাশিয়ার সীমানা থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে কালাচি এবং ক্র্যাসনোগর্স্ক উত্তর কাজাখস্তানের দুটি গ্রাম। এখানকার প্রধান জনগোষ্ঠী তুর্কী। সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি অংশ হলেও, এই উভয় গ্রামেই জার্মান এবং রাশিয়ান বাসিন্দারা প্রাধান্য পেয়েছিল। একটা সময় ছিল যখন এই গ্রামগুলোতে ছয় হাজারেরও বেশি লোক বাস করত।

তবে কোনো এক অজানা কারণে ওই স্থানটিতে ধীরে ধীরে মানুষের সংখ্যা কমতে শুরু করেছিল। অনেক লোক অন্যত্র চলে যেতে শুরু করেছিল। জনসংখ্যা হ্রাসের পরে হাজার হাজার মানুষ সেই জায়গায় আসেন। লোকসংখ্যা কম হওয়ার কারণে সেখানকার স্থানীয়রা প্রত্যক্ষ করল এক আজব ঘটনা।

রহস্যময় ঘটনার সূচনা-এই গ্রামে ঘুমের ঘটনার কথা জানা যায় ২০১৩ সাল থেকে। তখন থেকেই এই ঘুম গ্রামের সবার চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত ঘুমানোর ফলে শরীরে অসম্ভব ক্লান্তি অনুভব করতে শুরু করে এলাকাবাসী। এতোটাই ক্লান্ত অনুভব করে যে, তারা দাড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলে। অনেকে রাস্তার ফুটপাতে বসে ঘুমাতে থাকে। যারা কর্মস্থলে ছিলেন তারা অনেকেই অফিসের টেবিলে ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎই উভয় গ্রামের প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ এই অদ্ভুত ঘুমের ব্যাধিতে ভুগতে শুরু করলেন।

ঘুমের এই অসুস্থতা এতটাই মারাত্মক হয়ে ওঠে, যারা এই জাতীয় রোগে ভুগছিলেন তারা ঘুমের কারণে চোখ খোলা রাখতে পারতেন না। পরবর্তীতে অকারণে ঘুমিয়ে পড়া মানুষগুলো ঘুম থেকে উঠে কিছুই মনে করতে পারতেন না। তারা কখন ঘুমিয়ে পড়তেন? কী কারণে ঘুমিয়ে পড়তেন? তারা কিছুই মনে করতে পারতেন না।

এদিকে অতিরিক্ত ঘুমের কারণে মাথাব্যথা ও দুর্বলতার মতো শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হতেন তারা। ওই গ্রামে এমনও ঘটেছে যে, একজন একটি দিনে ছয় থেকে সাত বারের বেশি ঘুমিয়ে পরেছেন। আবার অনেকে দুই থেকে তিন দিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। গ্রামে এই অসঙ্গতি কার্যকলাপটি এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে এ জাতীয় ঘটনাকে ঘুমের ঘোলা বলে অভিহিত করেছেন।

রাশিয়ান সংবাদপত্র কমসোলস্কায়া প্রভাটারের তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে জানা যায়, ঘুমন্ত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নাক ডেকে ঘুমান। যখন তাদের ঘুম ভাঙে তখন এসবের কিছু মনে করতে পারে না। সঙ্গে থাকে কান্তি আর মাথাব্যথা। ঘুমের এই অসুস্থতা শিশুদের মধ্যে মারাত্মকভাবে বাড়তে থাকে। এজন্য অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করলেও সমস্যার সমাধান হয়নি।

ঘুমের কারণ-মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের কারণে অনেক বাচ্চাদের হ্যালুসিনেশনের সমস্যা হতে শুরু করে। হ্যালুসিনেশন এর মানে হচ্ছে, কোনো ঘটনা বাস্তবে ঘটছেনা কিন্তু মানুষের মস্তিষ্কে ঘটছে। এদিকে মানুষটি ভাবে তার সঙ্গে সত্যি সত্যি এমন কিছু হচ্ছে। এই রোগে আক্রান্ত এলাকার কিছু শিশুরা বলেছে, ঘুমের মধ্যে তারা দু’পাশে ডানা যুক্ত ঘোড়া দেখেছিল। অনেকে তার বিছানায় সাপ দেখেছেন। অন্যরা বলছে পোকামাকড় দ্বারা তাদের হাত খেতে দেখেছেন। ঘুমের মধ্যে অনেকেই আজব স্বপ্ন দেখা শুরু করে। আজব এই ঘটনার কারণে গ্রামের সবাই সবর্দাই অনেক আতঙ্কিত থেকেছে।

ওই গ্রামের বাসিন্দা জেলেনি ঝাবোরনকোভা বলেন, এক শনিবার রাত থেকে দুপুর পযর্ন্ত তার বিড়লিতে মানুষের মতো নাক ডেকে ঘুমাতে দেখে। কিছুই না খেয়ে র্দীঘসময় বিড়ালকে অস্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে দেখে তিনি অবাক হয়ে যান। অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এই ঘুমের ব্যাধি নিয়ে বিভিন্ন পরিক্ষা ও গবেষণা করেছেন। কিন্তু সন্ধান পায়নি কোনো ওষুধের। তবে এই রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা এটিকে মানসিক ব্যাধি হিসেবে অভিহিত করেন। অনেক স্থানীয় লোক আস্তে আস্তে এ ঘটনাকে একটি ভীতিজনক কারণ হিসাবে অভিহিত করছেন।

তবে বিজ্ঞানীরা এই তত্ত্বটিকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তারা সর্বদা ভেবেছিল যে এর পিছনে একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা যায়, গ্রামটির কাছে একটি ইউরেনিয়াম খনি আছে। খনিটি পূর্ববর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় বেশ সমৃদ্ধ হয়েছিল। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। যার কারণে খনিটি গ্রামীণ অবস্থায় পড়ে থাকে। কিন্তু ঘুমের অসুস্থতার প্রকোপ বাড়ার কারণে খনিটি বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করে।

কাজাখস্তানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সেই সময় অনেকটা এগিয়ে ছিল। তাই তারা কিছু অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ গবেষক ও মন্ত্রণালয়ের চিকিত্সকদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিলেন। এই তদন্ত কমিটিতে গ্রামের আশেপাশের লোকদের পরীক্ষা করার জন্য বিশেষ দল পাঠানো হয়েছিল। তারা সাত হাজারেরও বেশি লোকের ওপর পরীক্ষা চালায়। কিন্তু অনেক পরীক্ষা সত্ত্বেও, দলটি গ্রামবাসীদের মধ্যে কোনো উচ্চ বিকিরণ বা ক্ষতিকারক পদার্থ খুঁজে পায়নি। যদিও কয়েকটি বাড়িতে রেডিয়াম পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু এটি অতিরিক্ত ছিল না।

গবেষকরা ধারণা করেছিলেন, অতি মাত্রায় রেডিয়েশনের কারণে এমনটা হয়ে থাকতে পারে। এছাড়াও এর কারণ হতে পারে কাবর্ণ মনোঅক্সাইড, রেডন বা ধাতব লবণ। যা নিদির্ষ্ট পরিমাণের বেশি হলে মানুষের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে। তবে গবেষকরা নিশ্চিত হন, ইউরেনিয়াম খনিটি ঘুমাতে শুরু করেছে। সমীক্ষার এক পর্যায়ে তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে ইউরেনিয়াম খনি বন্ধ হয়ে গেলেও এর প্রভাব এখনো ছিল। ওই অঞ্চলে বাতাসের ঘনত্ব পরীক্ষা করার পরে তারা মন্তব্য করেন, খনিজগুলো গ্রামে কার্বন মনোক্সাইড এবং হাইড্রোকার্বনকে বাড়িয়ে তুলছে। এ কারণে অক্সিজেন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।

এ কারণ অনুধাবন করার পর স্থানীয় প্রশাসন খুব তাড়াতাড়ি জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করে। অল্প সময়ের মধ্যেই সরকার প্রায় ২২৫ পরিবারকে গ্রাম থেকে অপসারণের ব্যবস্থা করেছিল। তাদেরকে সরিয়ে নেয়া হয় নিরাপদ স্থানে। তবে আপনাদের কারো যদি ঘুমের প্রয়োজন হয় তবে আপনি চলে যেতে পারেন সেই রহস্যময়ী ঘুমন্ত মায়াপুরীতে।

ad

পাঠকের মতামত