298309

অবশেষে হেরে গেলে অগ্নিদগ্ধ সেই ছাত্রী

নরসিংদী প্রতিনিধিঃ দীর্ঘ ১৩ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে না ফেরার দেশে চলে গেলেন নরসিংদী বীরপুর এলাকার কলেজছাত্রী ফুলন বর্মণ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার ভোরে তার মৃত্যু হয়।

ফুলতের মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে আশে পুরো এলাকায়। মরদেহ বাড়িতে পৌছলে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। স্বজনদের আহাজারিতেভারী হয়ে ওঠে গোটা পরিবেশ। ফুলনের মরদেহ এক নজর দেখতে হাজারো মানুুষ ভিড় জমায়।এদিকে মামলার তদন্ত, আসামি গ্রেপ্তার ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন নিহতের পরিবার।

গত ১৩ জুন বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে নরসিংদীর বীরপুর এলাকার কলেজছাত্রী ফুলন বর্মন কেক নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। বাড়ির আঙিনায় পৌছলে আগে থেকে ওৎপেতে থাকা দুই দুর্বৃত্ত তার হাত মুখ চেপে ধরে। পরে টেনে হিচরে পাশের নির্জন স্থানে নিয়ে তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।

ওই সময় তাকে উদ্ধার করে প্রথমে নরসিংদী সদর হাসপাতালে ও পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। ওই সময় ঘটনাস্থল থেকে ফুলনের মাথার পোড়া চুল, একটি কোরোসিনের বোতল, পোড়া কাপড়, দিয়াশলাইসহ বিভিন্ন আলামত জব্দ করে পুলিশ।

এ ঘটনায় তার বাবা যোগেন্দ্র বর্মন আজ্ঞাতনামা দুই জনকে আসামি করে সদর মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। তবে ফুলনের মা অঞ্জলী বর্মণ বলেন, বাড়ি নিয়ে আমাদের প্রতিবেশীদের সাথে ঝামেলা ছিলো। আমাদের হুমকি দেয়া হয়েছিল। বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলবে ও আমাদের এলাকা থেকে বিতাড়িত করবে। ফুলন মৃত্যুর পূর্বে প্রতিপক্ষ সৌরভ ও তার পরিবারকে আগুন দেয়ার জন্য দায়ী করে গেছে।

ফুলনের ভাই সুমন বর্মন বলেন, আমরা যাদেরকে সন্দেহ করছি পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার করেনি। বরং তারা আমার ফুফাতো ভাইকে গ্রেপ্তার করেছে। ভবতোষ ভয় পেয়ে দোষ স্বীকার করেছে কিনা, তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ রয়েছে। তাই আমি তাদের সাথে কথা বলতে চাই। দোষী যেই হোক আমরা অবিলম্বে প্রকৃত অপরাধীর বিচার চাই।

নিহত ফুলনের বাবা যোগেন্দ্র বর্মন বলেন, আগুনে ফুলনের শরীরের ২১ শতাংশ পুড়ে যায়। মুখে কেরোসিন ঢালার কারণে ফুলনের শ্বাসনালীতে সমস্যা হয়েছিলো। যার কারণে শ্বাস নিতে কষ্ট হতো। এজন্য চিকিৎসকরা ফুলনের অপারেশন করেন। এর পর থেকে ফুলন ভালোই ছিলো। কিন্তু গতকাল থেকে তার বমি ও শ্বাস কষ্ট বেড়ে যায়।

পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় নিহত ফুলনের বাবা যোগেন্দ্র অজ্ঞাতনামা দুই জনকে আসামি করে সদর মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্ত ভার পড়ে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ডিবির উপ-পরিদর্শক আব্দুল গাফফারের নেতৃত্বে অভিযানে নামে পুলিশ।

এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সঞ্জিবসহ ৪ জনকে আটক করে পুলিশ। পরে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ২০ জুন বৃহস্পতিবার রাতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে রাজু সূত্রধর নামে একজনকে শহরের শিক্ষা চত্বর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় পুলিশের কাছে আগুন দেয়ার কথা স্বীকার করেন রাজু। রাজুর দেয়া তথ্য মতে ফুলনের ফুফাতো ভাই ভবতোষ ও আনন্দকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

রাজু ২১ জুন শুক্রবার বিকেলে নরসিংদীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শারমিন আক্তার পিংকীর আদালতে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে জবানবন্দী দেন। এরপর শনিবার বিকেলে কলেজছাত্রী ফুলনের ফুফাতো ভাই ভবতোষ বর্মণ নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শাহিনা আক্তারের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন।

জবানবন্দীতে রাজু ও ভবতোষ উল্লেখ করেন, ফুলনের ফুফাতো ভাই ভবতোষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাজু সূত্রধর ও আনন্দ বর্মণ। ফুলনের বাবা যোগেন্দ্রের সঙ্গে প্রতিবেশী সুখ লাল ও হিরা লালের বাড়ির জমি সংক্রান্ত বিরোধ চলছিল। এ নিয়ে এলাকায় সালিশ দরবার হয়েছে। ঘটনার দুই দিন আগে ১১ জুন মঙ্গলবার ভবতোষ ও তার মামীর (ফুলনের মা) সঙ্গে ঝগড়া হয় প্রতিবেশী সুখ লালের। এ ঝগড়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে ফুলনের মা বলেন, এখানে থাকবো না। দরকার হয় জমি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাবো। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফুলনের শরীরে আগুন দিয়ে প্রতিবেশীকে মামলায় ফাঁসানোর পরিকল্পনা করে কলেজছাত্রী ফুলনের ফুফাতো ভাই ভবতোষ। ঘটনার দিন ভবতোষ তার বন্ধু রাজু সূত্রধর ও আনন্দ বর্মণকে নিয়ে বীরপুর রেললাইনে বসে পরিকল্পনা করে।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে ঘটনার দিন রাতে ফুলন কেক নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে রাজু ফুলনের মুখ চেপে ধরে আর আনন্দ মাথায় ও শরীরে কেরোসিন ঢালে। আর ভবতোষ দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন দেয়ার পর ভবতোষ, আনন্দ একদিক দিয়ে ও রাজু অন্যদিক দিক দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

পুলিশের তদন্তকে সঠিক উল্লেখ করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপ পরিদর্শক (এসআই) আবদুল গাফফার বলেন, গ্রেপ্তারকৃত ভবতোষ প্রথম থেকেই ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। ভবতোষের বন্ধু আনন্দ যেখান থেকে কেরোসিন কেনা হয়েছে সেটার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। শুধু তাই নয়, আনন্দকে কেরোসিন দোকানদারের সামনা সামনি করা হয়েছে। ওই সময়ও সে স্বীকার করেছে। এখন প্রতিবেশি সুখ লাল ও হিরা লাল বাড়ি থেকে চলে যাওয়ায় তাদের দিকে সন্দেহ করতে থাকে নিহতের পরিবার।

তিনি আরো বলেন, এই মামলায় এখন পর্যন্ত ৭জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৩ জন সরাসরি এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা আদালতে স্বীকার করেছে। পরিবারের লোকজনের দ্বিমত থাকলেও পুলিশের কাছে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রয়েছে।

ad

পাঠকের মতামত