293840

চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না: একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে

(একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে) অনেকদিন আগের একজন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকের জীবনের একটা ঘটনা বলি। শিক্ষক ক্লাসে খুব ভালো পড়াতেন, ছেলেমেয়েরা কেউ ক্লাসে অমনযোগি হলে বা পড়া না করে আসলে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে থাকতেন, তারপর কাছে ডেকে নিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন-

-এই যে আমি এতো বকবক করি আর তোরা আমার কথা শুনিসনা,পড়ায় ফাঁকি দিস ; তোরা কি মনে করিস আমাকে ফাঁকি দিচ্ছিস! না, তোরা আসলে নিজেই নিজেকে ফাঁকি দিচ্ছিস। আমার এই কথার অর্থ তোরা এখন বুঝবিনা, বড় হলে ঠিকই বুঝবি।

তো একদিন তিনি ক্ষোভে পড়েই বললেন–আচ্ছা, আমি তোদের লেখাপড়া নিয়ে এতো মাথা ঘামাই, এতো বকাঝকা করি; তোরা কি বলতে পারিস- এতে আমার লাভ কি? তোরা কি বড়ো হয়ে- বড়ো বড়ো অফিসার হয়ে ইনকাম করে আমাকে কি কেউ খেতে দিবি নাকি, বল্ ! সবাই তো একদিন আমাকে ভুলে যাবি !
এই কথা শুনে ক্লাসের এক কোনা থেকে একজন ছোট্ট ছেলে উঠে দাড়িয়ে বলল-
-স্যার, আমি বড়ো হয়ে বড়ো চাকরি করে আপনাকে খেতে দেবো।

শিক্ষক হা হা হা করে হেসে উঠে বললেন- -আচ্ছা, আচ্ছা তুই আমাকে খেতে দিস্, দোয়া করি অনেক বড়ো মানুষ হ’। তারপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে, সেই শিক্ষক রিটায়ার করেছেন।সারাজীবন পরের ছেলেমেয়ে মানুষ করতে গিয়ে নিজের ছেলেমেয়েই মানুষ করতে পারেননি। শরীরে অসুস্থতা বাসা বেঁধেছে।অনেক কস্টে তার দিন কাটে। হঠাৎ একদিন পোস্ট অফিসের পিয়ন এসে শিক্ষকের হাতে অনেক গুলো টাকার একটা খাম দিয়ে বলল –

-মাস্টার সাহেব, সই করেন, আপনার নামে টাকা এসেছে, তবে প্রেরকের নাম ঠিকানা নেই।
বৃদ্ধ শিক্ষক বুঝতে পারছেননা কে তার নামে টাকা পাঠালো। তার তো এরকম কেউ নেই যে তার নামে টাকা দেবে। মাস্টার সাহেব টাকা নিতে চাচ্ছেন না, বললেন- -এই টাকা মনে হয় অন্য কারোর নামে, তোমার মনে হয়, ভুল হচ্ছে। পিয়ন বলে – না এটা আপনার নামেই এসেছে।

এরপর প্রতি মাসেই এরকম ঘটনা শুরু হলো। টাকা আসে, পিয়ন দিয়ে যায়। একদিন হঠাৎ শিক্ষকের বাড়ীর সামনে একটা দামী গাড়ী এসে দাড়ালো, গাড়ী থেকে স্যুট-কোট পরা একজন ভদ্রলোক নেমে আসলেন। লোকটা সরাসরি এসে বৃদ্ধ শিক্ষকের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন। মাস্টার সাহেব ভাঙ্গা চশমার কাঁচটা মুঁছে লোকটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন –

-তুমি কে বাবা? আমি তো তোমাকে ঠিক চিনতে পারছিনা। তখন ভদ্রলোকটি বললেন- -স্যার, আপনি কেমন আছেন? আমি বাংলাদেশের একজন বড়ো সচিব। প্রতি মাসে আমি আপনার খাওয়া খরচের জন্যি কিছু টাকা পাঠাই। আমি আপনাকে কথা দিয়েছিলাম স্যার, আমি বড়ো হয়ে চাকরি করে আপনাকে খেতে দেবো। আপনি কি এবার আমাকে চিনতে পেরেছেন?
বৃদ্ধের মনে পড়ে গেলো অনেক বছর আগে ক্লাসের সেই ছোট্ট ছেলেটার কথা-“বড়ো হয়ে আমি আপনাকে খেতে দেবো স্যার..”। বৃদ্ধের চোখ দুটো এবার জলে ভরে গেলো, বুকে জড়িয় ধরে বুড়ো মানুষটা বাচ্চা ছেলের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।

-ওরে পাগল ! তুমিই তাহলে প্রতি মাসে টাকা পাঠাও! আমি বুঝিনা কে পাঠায়। অসুস্থ মানুষ, অভাবে পড়েছি, আত্মীয় স্বজন কেউ আসেনা, নিজের ছেলেমেয়েরা কেউ খোঁজ নেয়না, তবুও আমি তোমার টাকাগুলো খরচ করিনি, যেরকম পাঠিয়েছো সেইরকম করেই জমা করে তুলে রেখে দিয়েছি।আশা ছিলো একদিন টাকার আসল মালিককে খুঁজে সব টাকা ফেরত দেবো। তোমার টাকাগুলো তুমি নিয়ে যাও বাবা।

তুমি আমাকে মনে রেখেছো, একজন শিক্ষকের জন্য যে সন্মান আর ভালোবাসা তুমি দেখালে এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওয়া। আমি দোয়া করি তুমি আরো বড়ো হও, কোনোদিন কোনো কস্ট যেনো তোমার গায়ে না লাগে। এতক্ষণে সেই মানুষটার চোখেও পানি চলে এসেছে। আঁশেপাশে মানুষজন দাড়িয়ে দেখছে, দুই প্রজন্মের দু’জন বয়স্ক মানুষ বাচ্চা ছেলেদের মতো করে কাঁদছে…….।

(গল্পটি পড়ে কেমন লাগলো কমেন্ট লিখলে খুশি হবো।) -তরিকুল ইসলাম মিঠু। প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক। বর্তমান: নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, ইউএসএ।

ad

পাঠকের মতামত