291227

বিদ‘আত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন মুসলিম সম্রাট আওরঙ্গজেব (রহ.)

ইসলাম ডেস্ক।। সম্রাট আওরঙ্গজেব, যিনি আবুল মুযাফফর মহিউদ্দীন মুহাম্মদ আলমগীর বা জগত-বিজয়ী নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশ ও এর আশপাশস্থ রাজ্যের সম্রাট। তিনি ছিলেন তৈমুর লংয়ের উত্তরসূরি। তার জন্ম ১৫ জিলহজ ১০২৪ হিজরি সাল মোতাবেক ২৪ অক্টোবর ১৬১৯ ঈসাব্দে। মৃত্যু ২৪ জিলক্বদ ১১১৮ হিজরি মোতাবেক ২০ ফেব্রুয়ারি ১৭০৭ইং সালে।

ফারসিতে আওরঙ্গজেবের অর্থ আরশের সৌন্দর্য। আওরঙ্গ অর্থ আরশ আর জেব অর্থ সৌন্দর্য। আর ফারসি আলমগীর অর্থ জগদ্বিজয়ী। আলমগীর ভারতীয় মুসলিম মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম সেরা সম্রাট শাহজাহানের ছেলে। যিনি (শাহজাহান) প্রিয়তমা স্ত্রীর সমাধিস্থল হিসেবে সপ্তমাশ্চর্যের অন্যতম তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন। যেখানে সমাধিস্থ করা হয় মমতাজ মহল নামে খ্যাত আবুল মুযাফফরের জননীকে। সম্রাট তার ভালোবাসায় অতি আসক্ত ছিলেন। এমনকি এজন্য তিনি রাজা হিসেবে থাকার অযোগ্য হয়ে পড়েন। ফলে নিজ জীবদ্দশায় ভাইদের সঙ্গে একাধিক যুদ্ধের পর আপন তনয় সুলতান আবুল মুযাফফরকে রাজ্যভার অর্পণ করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব অন্য মোগল সম্রাটদের মতো ছিলেন না। বরং তার জীবন-কথায় তিনি আলেম, ইবাদতগুযার, দুনিয়াবিমুখ, মুত্তাকীও কবি হিসেবে সুপরিচিত। তিনি শাখাগত বিষয়াদিতে ছিলেন হানাফী মাযহাবপন্থী। সেহেতু তিনি অপরাপর মোগল সম্রাটদের মতো ছিলেন না, ছিলেন তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।

মহান কীর্তিমালা : তিনি বিদ‘আত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। নিজে গান-বাজনায় দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও তা শোনা ত্যাগ করেন। পৌত্তলিক ও বিদ‘আতী উৎসবাদি বাতিল করেন। রহিত করেন শির নত করা এবং মাটিতে চুমু খাওয়া। যা পূর্বতন রাজন্যবর্গের জন্য করা হতো। বিপরীতে তিনি ইসলামী সম্ভাষণ-বাক্য তথা ‘আসসালামু ‘আলাইকুম’-এর মাধ্যমে অভিবাদন জানানোর নির্দেশ দেন।

সম্ভবত এ কারণে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী কিছু লেখক তাকে গোঁড়া হিসেবে অপবাদ দেন। এটি সম্ভবত তাদের কাউকে কাউকে তাকে সালাফী মনে করিয়েছিল। অবশ্য এসব বিষয়ে তিনি সন্দেহাতীতভাবে সালাফী ছিলেন। যদিও তিনি ছিলেন হানাফী মাযহাবপন্থী। আর এ দেশগুলোয় তখন হানাফীরা আকীদার ক্ষেত্রে মাতুরীদীয়্যা ছিলো। অনেক জীবনীকার তাকে সূফী হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। বস্তুত আল্লাহই ভালো জানেন তার অবস্থা ও বিশ্বাস সম্পর্কে।

তার সম্পর্কে আমরা নিশ্চিতরূপে কিছু জানি না। জীবনালেখ্যে তার কর্ম ও কীর্তিই বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। যেমন তার ইবাদতমুখিতা, দুনিয়াবিমুখতা ও ধার্মিকতা। এসব বিষয়ে জীবনীকারগণ প্রশংসনীয় অনেক কিছু লিখেছেন। প্রশংসিত কাজগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কুসংস্কার ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, রাফেযি-শিয়া রাজ্যগুলো নির্মূল এবং বিদ’আতি ও পৌত্তলিক উৎসবাদি নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি। এসবের দাবি হলো, তিনি সম্মান, মর্যাদা, নেক দু‘আ পাওয়ার উপযুক্ত। তার এ পদ্ধতি ছিলো শাসনকার্য পরিচালনায় সালাফ তথা পূর্বসুরীদের কর্মপন্থার বাস্তব প্রয়োগ।

এ কারণে আরব সাহিত্যিক শাইখ আলী তানতাবি (রহ.) তার ক্ষেত্রে ‘খুলাফায়ে রাশিদিনের অবশিষ্টাংশ’ উপাধি প্রয়োগের দাবি করেছেন। নিজের রচিত ‘রিজালুম মিনাত-তারিখ’ (ইতিহাসের মনীষীরা) গ্রন্থে তিনি তার অমূল্য জীবনী সংযুক্ত করেছেন। আওরঙ্গজেবের জীবনী শেষ করেছেন তিনি এ কথা বলে, ‘সম্রাট এমন দু’টি বিষয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা পূর্ববর্তী কোনো মুসলিম শাসক সক্ষম হননি :

প্রথম : তিনি পাঠদান কর্ম সম্পাদন বা কিছু সংকলন ইত্যাদি কাজ দাবি করা ছাড়া কোনো আলেম বা পণ্ডিতকে উপঢৌকন বা সম্মানি দিতেন না। এমন যাতে না হয় যে তিনি সম্পদ পেলেন আর অলস হয়ে গেলেন। এতে করে দুটি মন্দ কাজের সন্নিবেশ হবে- অধিকার ব্যতীত সম্পদ গ্রহণ এবং জ্ঞান গোপন করা।

দ্বিতীয় : তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি শরিয়তের বিধি-বিধানগুলো এক কিতাবে লিপিবদ্ধ করেন, যাকে আইন হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তারই নির্দেশ, তত্ত্বাবধান ও সুনজরে ফাতওয়া সংকলনগ্রন্থ প্রণীত হয়। তার নামে যার নাম দেওয়া হয় ‘ফাতাওয়া আলমগীরী’। এটি ‘ফাতাওয়া হিন্দিয়া’ নামে সুবিখ্যাত। ফিকহে ইসলামীতে বিধি-বিধান সংক্রান্ত সবচেয়ে বিখ্যাত ও বিন্যাসের দিক থেকে সবচেয়ে অনবদ্য গ্রন্থ।’ (রিজালুম মিনাত-তারীখ, পৃ. ২৩৬)

সম্রাটের নিকটতম সময়ে যিনি তার জীবনী রচনা করেছেন, তিনি হলেন আবুল ফযল মুহাম্মদ খলীল ইবন আলী আল-মুরাদী রহ. (মৃত্যু : ১২০৬ হি.)। তিনি আওরঙ্গজেবকে সুফিসাধক হিসেবে বিশেষিত করে তার জীবনীতে লিখেছেন : ‘(সম্রাট আওরঙ্গজেব) আমাদের যুগে হিন্দুস্থানের সম্রাট, আমিরুল মুমিনীন ও ইমাম তথা মুমিনদের নেতা ও আমীর, মুসলিমদের এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার স্তম্ভ, আল্লাহর পথের মুজাহিদ, বিশিষ্ট আলেম ও আল্লামা, আরেফবিল্লাহ বা আল্লাহর পরিচয় লাভকারী সূফী এবং দীনের সাহায্যে অটল বাদশাহ। নিজ দেশে তিনি কাফিরদের নির্মূল করেন। তাদের করেন পরাস্ত। তাদের গির্জাগুলো গুঁড়িয়ে দেন। তাদের অংশীদারদের করেন দুর্বল। ইসলামের সাহায্য করেন এবং হিন্দুস্থানে ইসলামের মিনার উঁচু করেন। আল্লাহর কালামকে করেন একমাত্র বুলন্দ। হিন্দুস্থানের কাফিরদের থেকে তিনি জিযয়া গ্রহণ করেন। শক্তি ও সংখ্যাধিক্য হেতু যা ইতোপূর্বে কোনো বাদশাহ গ্রহণ করতে সক্ষম হননি। অব্যাহতভাবে তিনি সুবিশাল সব রাজ্য বিজয় করে যান। যখনই তিনি কোনো শহর বিজয় করতে চাইতেন, তা করেই ছাড়তেন। এমনকি আল্লাহ তাকে সম্মানের জগতে স্থানান্তর অব্দি তিনি ছিলেন জিহাদে। যাবতীয় সময় ব্যয় করেছেন দ্বীনের কল্যাণ ও মহান পালনকর্তার খেদমতে। যেমন সিয়াম, কিয়াম ও সাধনায়- যার কোনোটিও অনেকগুলো মানুষের জন্য কঠিন। এটা আসলে আল্লাহর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন।

সম্রাট আলমগীর নিজের সময়গুলো ভাগ করে নিতেন। নির্দিষ্ট সময় ছিল ইবাদত, পাঠদান, সামরিক দফতর, ফরিয়াদকারী, দিনে-রাতে আগত রাজ্যের সংবাদ ও চিঠি পাঠ ইত্যাকার প্রত্যেক কাজের জন্য। একটি কাজের সঙ্গে অন্য কাজের সময় কখনো একাকার হত না। এককথায় তিনি ছিলেন সময়ের সৌন্দর্য-তিলক, সাম্রাজ্য পরিচালনায় তুলনারহিত। তার সাম্রাজ্য ও উত্তম জীবনী নিয়ে ফারসিতে অনেক দীর্ঘ বই সংকলিত হয়েছে। আগ্রহী ব্যক্তিগণ চাইলে সেসব পড়ে দেখতে পারেন।’ (সিলকুদ-দুরার ফি আ‘ইয়ানিল কারনিছ-ছানি ‘আশার : ৪/১১৩)

গ্রন্থকার উপরোক্ত বক্তব্যের পর আরও লিখেন, ‘তিনি ১০৬৮ সাল থেকে রাজ্য পরিচালনায় নিযুক্ত হন। হিন্দুস্থানবাসীদের জন্য আল্লাহ কল্যাণের ইচ্ছা করেন। তিনি জুলুম ও অত্যাচার উঠিয়ে দেন। হিন্দুস্তানের দিগন্তে তার ঊষা উদিত হয়। তৈমূরের গম্বুজে পূর্ণিমার চাঁদ উদ্ভাসিত হয়। তার মর্যাদার নক্ষত্র ঘূর্ণায়মান। তার সৌভাগ্যের সেতারা সুপ্রসারিত। তিনি অধিকাংশ প্রসিদ্ধ হিন্দু রাজাকে বন্দি করেন। তাদের রাজ্যগুলো তার আনুগত্যের অধীনে আসে। তার কাছে সম্পদরাশি স্তূপীকৃত হতে থাকে। বিভিন্ন দেশ ও প্রজারা তার আনুগত্য করে। তিনি সর্বদা জিহাদে সচেষ্ট থাকতেন। রাজ্য ও রাজত্ব থেকে (জিহাদের উদ্দেশ্যে) বের হওয়া পর আপন নিবাসে আর ফিরে যাননি। একটি দেশ বিজয়ের পরই আরেকটি বিজয়ের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। সংখ্যাধিক্যের দরুণ তার সৈন্য ছিল গণনাতীত। তার মহত্ত্ব ও শক্তি ছিল বর্ণনাতীত। রাজত্ব বানিয়েছেন তিনি একমাত্র আল্লাহর জন্যই। তিনি হিন্দুস্থানে ইলম-জ্ঞানের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। আলেম ও জ্ঞানীদের সম্মান এতোটা বৃদ্ধি করেন যে বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের সমাবেশ ঘটতে থাকে।’

সারকথা : সচ্চরিত্র, আল্লাহভীতি ও ইবাদতনিষ্ঠায় তার যুগে মুসলিম সম্রাটদের কোনো উপমা ছিল না। তিনি বিভিন্ন রাজ্যের হানাফি আলেমদের তার নামে এমন ফাতওয়া-গ্রন্থ সংকলনের নির্দেশ দেন, যাতে শরিয়তের প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান সম্পর্কিত তাদের মাজহাবের প্রায় সবই সন্নিবেশিত হবে। নির্দেশমাফিক বহু খণ্ডে তা রচিত হয় এবং এর নামকরণ করা হয় ‘ফাতাওয়া আলমগীরী’। এটি প্রসিদ্ধি লাভ করে হিজায, মিসর, শাম ও রোমক দেশগুলোয়। এর উপকারিতা ব্যাপকতর রূপ নেয় এবং এটি মুফতিদের উদ্ধৃতিগ্রন্থ হিসেবে সুপরিচিত হয়ে ওঠে। তিনি ১১১৮ ঈসাব্দে যিলকদ মাসে হারাম শরিফের রুকনে ইয়ামানিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মরদেহ বাপ-দাদার দেশে স্থানান্তর করা হয়। তিনি মোট ৫০ বছর রাজত্ব পরিচালনা করেন। আল্লাহ তার ওপর রহমত বর্ষণ করুন।’ (প্রাগুক্ত)। আরও বিস্তারিত জানতে উস্তায আব্দুল মুন‘ইম নামির রচিত ‘তারিখুল ইসলাম ফিল হিন্দ’ গ্রন্থের ২৮৬ নং পৃষ্ঠা দেখুন।

ad

পাঠকের মতামত