290059

প্রাথমিকের প্রশ্নপত্র তৈরি করতে হবে নিজ নিজ স্কুলে

প্রাইমারি সেক্টরে প্রশ্নপত্র তৈরির সিন্ডিকেট ভাঙতে নতুন নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন আর উপজেলা শিক্ষক সমিতি কোনো প্রশ্ন তৈরি করতে পারবে না। প্রশ্ন তৈরি হবে নিজ নিজ স্কুলে। সরকারি এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষকরা।

শিক্ষকরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে প্রাইমারি সেক্টরের বিভিন্ন শ্রেণির প্রশ্নপত্র তৈরি করে আসছে চিহ্নিত কিছু শিক্ষক। যারা প্রশ্ন তৈরি, মডারেশন এবং বিতরণ সবকিছুর সাথেই সংশ্লিষ্ট থাকেন। বিশেষ করে শিক্ষক নেতাদের প্রাধান্য থাকে এসব কাজে। যারা স্পর্শকাতর এ কাজে সংশ্লিষ্ট থাকেন তাদের অনেকেই আবার প্রাইভেট পড়ানোর সাথে জড়িত। ফলে, তাদের দ্বারা প্রশ্ন ফাঁস হয়। সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বরে যশোরে বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। এটি সদর উপজেলার ক্ষেত্রে ঘটে। এ কারণে নতুন করে প্রশ্ন তৈরি করে রাতে বিতরণ করা হয়।

সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভাগীয় উপপরিচালকদের দ্বিমাসিক সভায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল সাময়িক ও বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র স্ব স্ব বিদ্যালয় কর্র্তৃক প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত ৮ এপ্রিল এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার এ সিদ্ধান্ত খুলনা বিভাগীয় উপপরিচালক মেহেরুন নেছা গত ১০ এপ্রিল বিভাগের ১০ জেলার সকল প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে পাঠিয়েছেন জরুরিভাবে ব্যবস্থা নেয়ার জন্যে। যার স্মারক নম্বর বিপ্রাশিকা/খুবিখু/সাপ্র/দ্বিমাসিক সভা/১১৩৬। তারিখ ১০.০৪.২০১৯।

এদিকে, সরকারি এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন হাজার হাজার সাধারণ শিক্ষক। তারা বলছেন, স্ব স্ব স্কুলে প্রশ্ন তৈরি হলে একদিকে সিন্ডিকেট ভাঙবে। অপরদিকে, প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ হবে। একইসাথে শিক্ষকরা দক্ষ এবং অভিজ্ঞ হবেন। পাশাপাশি প্রশ্ন ফি থেকে উদ্বৃত্ত টাকা ভাগবাটোয়ারা বন্ধ হবে। যদি কোনো টাকা উদ্বৃত্ত থাকে সেটি স্কুলের কল্যাণে ব্যয় করা যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণিতে ১০ টাকা, প্রথম শ্রেণিতে ১৫ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২০ টাকা, তৃতীয় শ্রেণিতে ২৫ টাকা, চতুর্থ শ্রেণিতে ৩০ টাকা এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ৩৫ টাকা হারে প্রশ্ন ফি গ্রহণ করা হয়। প্রতিটি স্কুলে যে পরিমাণ প্রশ্ন ফি গ্রহণ করা হয় প্রশ্নপত্র ছাপতে সেই পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় না। প্রতিবারই বেশকিছু টাকা উদ্বৃত্ত থেকে যায়। ইতোপূর্বে যা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও শিক্ষক নেতাদের মধ্যে ভাগাভাগি হতো। বর্তমান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শেখ অহিদুল আলম যোগদানের পর থেকে এই ভাগাভাগি বন্ধ করে দেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এরপর উদ্বৃত্ত টাকা উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা পর্যন্ত ভাগাভাগি হচ্ছে।

সিন্ডিকেটের কারণে যশোরে গত বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়। মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ের প্রশ্ন। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর ফাঁস হওয়া প্রশ্ন বাতিল করে নতুন করে ছাপানো প্রশ্নে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্বে ছাপানো প্রশ্ন হঠাৎ করে পরিবর্তন করায় দুর্ভোগে পড়ে ৩০ হাজার কোমলমতি পরীক্ষার্থী। এমন অভিযোগ করেছিলেন শিক্ষকরা। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় সেসময় তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস।

প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয় গত ২৯ নভেম্বর থেকে। ৪ ডিসেম্বর বুধবার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। তারমধ্যে উভয় ক্লাসের বিজ্ঞান বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায়। কেবল ফাঁসই হয়নি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হওয়া এই প্রশ্ন ঘুরপাক খায় বলে একাধিক সূত্র সেসময় জানায়। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন অনেক অভিভাবকের হাতে পৌঁছায়। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর তোলপাড় সৃষ্টি হয় যশোরের প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে। এ কারণে তড়িঘড়ি করে আগের দিন বিকেলে শহরের একটি ছাপাখানা থেকে বিজ্ঞান বিষয়ের প্রশ্ন নতুন করে ছাপতে হয়। রাতে সেই প্রশ্ন প্রধান শিক্ষকদের ডেকে এনে তাদের হাতে ধরিয়ে দেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার কামরুল ইসলাম। সেসময় দূর-দূরান্ত থেকে আসা শিক্ষকদের প্রশ্ন নিয়ে রাতে বাড়ি ফিরতে রীতিমত দুর্ভোগে পড়তে হয়। এ নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় শিক্ষকদের মধ্যে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষক জানিয়েছিলেন, শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো বেশি বেশি পড়ে থাকে। প্রশ্নও হয় সেই আঙ্গিকে। পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে যে প্রশ্ন করা হয়েছিল তাতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ছিল। কিন্তু সেই প্রশ্ন বাদ দিয়ে পরবর্তীতে যা করা হয় সেটি একেবারেই দায়সারা গোছের। এ কারণে এর দায় চাপে শিক্ষার্থীদের ওপর। ২৪ নভেম্বর যশোর সদর উপজেলার দুশ’৫২ স্কুলের জন্যে নির্ধারিত প্রশ্ন গণনা করা হয়। শহরতলির বালিয়াডাঙ্গা স্কুলের সমিতি ভবনে গণনা করা হয় এসব প্রশ্ন। প্রশ্ন প্রণয়ন কমিটির সদস্যসহ ৫০ জনের মতো শিক্ষক এ কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাদের বাইরে সেখানে বহিরাগত কিছু শিক্ষকও ছিলেন বলে সূত্রের দাবি।

সূত্র জানায়, যেসব শিক্ষক বছরের পর বছর ধরে গণনার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন তাদের অনেকেই প্রাইভেট পড়ানোর সাথে জড়িত। একইভাবে বহিরাগত যেসব শিক্ষক সেখানে উপস্থিত ছিলেন তারা প্রাইভেট পড়ান বলে সূত্র জানায়। এসব শিক্ষকের কেউ কেউ প্রশ্ন পকেটে কওে, আবার কেউ কেউ মোবাইল ফোনে ছবি তুলে নিয়ে যান বলে সূত্রের দাবি। প্রশ্ন গণনার সময় উপজেলা শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তাদের মনিটরিং করার কথা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটি হয় না। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা শিক্ষকদের উপর ‘দায়িত্ব’ দিয়ে কেটে পড়েন। এই সুযোগে যা করার তাই করেন কোনো কোনো শিক্ষক। এভাবেই ফাঁস হয় প্রশ্ন।

সূত্র জানিয়েছে, প্রশ্ন প্রণয়ন এবং গণনার কাজে শিক্ষকদের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা বছরের পর বছর এ কাজ করে আসছেন। ফলে, প্রতি বছর তারা কোনো না কোনো অনৈতিক কর্মকান্ড করেই থাকেন। কখনও প্রকাশ পায়, আবার কখনও সেটি চাপা পড়ে থাকে। কিন্তু সর্বশেষ বার্ষিক পরীক্ষায় সেটি চাপা দিয়ে রাখতে পারেনি সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট। এ কারণে বিজ্ঞানের প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি নজরে আসে।

ওই সময় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শেখ অহিদুল আলম। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয় তৎকালীন সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (সাধারণ) নাসরিন আক্তারকে। অপর দু’ সদস্য ছিলেন সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (উন্নয়ন) আমজাদ হোসেন ও মনিটরিং অফিসার সোলাইমান হোসেন তালুকদার। ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল তদন্ত কমিটিকে।

প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে সেসময় সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার কামরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, প্রশ্ন ফাঁসের কথা শুনছি। এগুলো মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। যদি মূল প্রশ্নের সাথে মিলে যায় তা হলে নতুন করে প্রশ্ন বানিয়ে পরীক্ষা নেয়া হবে।

এসব বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শেখ ওহিদুল আলম বলেন, স্ব স্ব স্কুলে প্রশ্নপত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। প্রত্যেক শিক্ষকের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ তৈরি হবে। প্রতিযোগিতা হবে কে কতটা ভালো প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন।

ad

পাঠকের মতামত