289466

মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত হত্যাকাণ্ড: অনেক অপকর্মের সহযোগী ওসি মোয়াজ্জেম

নিউজ ডেস্ক।। ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার নিপীড়ক অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার সব অপকর্ম ধামাচাপা দিতেন সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। গত ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফির শরীরে পরীক্ষা কেন্দ্রে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পরও ঘটনাটি ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। নুসরাতের ওপর নিষ্ঠুর আক্রমণের প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামতে পারেন, এমন সবাইকে ফোন করে ওসি সতর্ক করেন। গতকাল আরও দু’জনকে আটক করা হয়েছে। তারা হলেন- সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম এবং মাদ্রাসাছাত্র জাবেদ হাসান। এর আগে ২৭ মার্চ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নুসরাত শ্নীলতাহানির অভিযোগ আনলেও বিষয়টিকে তেমন আমলে নেননি ওসি মোয়াজ্জেম। অভিযুক্ত সিরাজের বিরুদ্ধে মামলা নিয়েই তিনি তার ‘দায়িত্ব’ শেষ করেন। এ মামলার জের ধরে রাফির চরিত্র নিয়ে এলাকায় নানা গুজব ছড়ানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেননি তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা রাফির নামে নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে তাদেরও শনাক্ত করা হয়নি।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফেনীর সোনাগাজীর রাফির হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন। ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, হত্যাকারীদের বিচার দ্রুতবিচার আদালতে হবে। হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেছেন ২৮ বিশিষ্ট নাগরিক। রাজধানীর শাহবাগেও বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে। নুসরাতের পরিবার ও এলাকার সচেতন মহলের অভিযোগ, ওসির আশকারা পেয়েই অধ্যক্ষ সিরাজ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ এলাকায় দাপট নিয়ে চলতেন। একাধিকবার সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ছাত্রী-নিপীড়নের গুরুতর অভিযোগ উঠলেও তার কোনো সুরাহা হয়নি। সাহস ও প্রতিবাদ নিয়ে রাফি রুখে দাঁড়ানোর পর বেরিয়ে আসছে সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসা ঘিরে নানা অপকর্মের কাহিনী।

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও রাফি বলেছেন, ‘আমার যাই হোক, দোষীরা যেন কোনোভাবেই ছাড় না পায়। আমি এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করব। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। সারা বাংলাদেশের কাছে বলব। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলব। সারা পৃথিবীর কাছে বলব।’ টানা পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে গত বুধবার রাতে রাফি যখন না ফেরার দেশে চলে গেলেন, তখন কেঁদেছে লাখো মানুষ। রাফির প্রতি ভালোবাসা ও অপরাধীদের প্রতি চরম ঘৃণায় ভরে উঠেছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। রাফির পরিবার এবং সচেতন মহলেরও এখন একটাই দাবি, রাফিকে যেসব কাপুরুষ আগুন দিয়ে ঝলসে দিয়েছে, তাদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।

যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদকারী রাফি হত্যা মামলা কোনদিকে মোড় নেবে, সেদিকে খেয়াল রাখা হবে বলে জানিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকাল এ হত্যার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, ‘আপনারা খেয়াল রাখেন। আমরাও খেয়াল রাখছি। তদন্তের কোনো জায়গায় কোনো কারণে যদি মনে হয় গাফিলতি আছে, আপনারা চলে আসবেন, আমরা ইন্টারফেয়ার (হস্তক্ষেপ) করব।’ এদিকে ফেনীতে নুসরাত জাহান রাফির মামলায় গ্রেফতার আসামিদের পক্ষে আদালতে শুনানি করায় কাজিরবাগ ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট বুলবুল আহাম্মদ সোহাগকে দল থেকে বহিস্কার করেছে জেলা কমিটি। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ আবদুল হালিম গতকাল সমকালকে জানান, ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটিতে ছিলেন তিনি। তখনও অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ছাত্রী-নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল। প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে এসব ঘটনার তদন্ত তখন বেশি দূর এগোতে পারেনি। রাফি সাহস করে রুখে দাঁড়ানোয় বিষয়গুলো এখন সামনে আসছে। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মাদ্রাসার ৩৯ লাখ টাকা তছরুপের সুনির্দিষ্ট অভিযোগও পাওয়া গেছে।

শেখ আবদুল হালিম বলেন, অধ্যক্ষ সিরাজ মাদ্রাসার ছাত্র নুর উদ্দিন, শামীমসহ ১০-১২ জনকে পুষতেন। অধ্যক্ষের অপকর্মের কেউ কোনো প্রতিবাদ জানালে তারা পাল্টা কর্মসূচি দিত। সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোর করে নেওয়া হতো। ২৭ মার্চ রাফি শ্নীলতাহানির অভিযোগ আনলে একটি পক্ষ অধ্যক্ষের পক্ষে মানববন্ধন, মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। এ ধরনের কর্মসূচি পালন করতে তাদের কোনো বাধা দেননি ওসি মোয়াজ্জেম।

শেখ আবদুল হালিম জানান, শুরুতেই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হলে ঘটনাটি এত দূর আসত না। টাকা দিয়ে ম্যানেজ করাতেই ওসি অধ্যক্ষের পক্ষ নেন। ৬ এপ্রিল রাফির শরীরে আগুন দেওয়ার পর ওসি ফোন করে তাকে জানান, এ ঘটনার প্রতিবাদে বা পক্ষে-বিপক্ষে কোনো মিছিল-মিটিং করা যাবে না। স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করেন ওসি।

রাফিকে জিজ্ঞাসাবাদ!:২৭ মার্চ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগ করেন রাফি। এরপর সোনাগাজী থানায় যাওয়ার পর নিয়ম ভেঙে রাফির বক্তব্য ভিডিও করেন ওসি মোয়াজ্জেম। ভিডিওতে দু’জন পুরুষের কণ্ঠস্বর শোনা গেলেও সেখানে কোনো আইনজীবী বা অন্য কোনো নারী ছিলেন না। ভিডিওতে দেখা যায়, থানার ভেতরে রাফিকে জেরা করা হচ্ছে। তিনি অঝোরে কাঁদছেন। দু’হাতে মুখ ঢেকে রাখার চেষ্টা করছেন। এ সময় ওসি বলতে থাকেন, ‘মুখ থেকে হাত সরাও। কান্না থামাও। এমন কিছু হয়নি যে এখনও তোমাকে কাঁদতে হবে।’ এরপর ওসি তার কাছে জানতে চান, ‘কিসে পড়? ক্লাস ছিল? কারে কারে জানাইসো বিষয়টা?’ উত্তরে রাফি বলেন, ‘অধ্যক্ষ ডেকে নিয়ে গিয়েছিল।’ ওসি বলেন, ‘ডেকেছিল, নাকি তুমি ওখানে গেছিলা?’ রাফি জানান, নুর আলম নামে পিয়নের মাধ্যমে ডেকেছিল। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, হয়রানির শিকার কাউকে এভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা আইনসিদ্ধ নয়। ভিডিও ধারণ করার ঘটনাটি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ২৬ ধারা অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধ। চাইলে এ ঘটনায় ওসিকে অভিযুক্ত করে মামলা করা যায়।

পলাতক যারা :রাফি হত্যার ঘটনায় গতকাল আরও দু’জনকে আটক করেছে পুলিশ। তারা হলেন- সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম এবং মাদ্রাসাছাত্র জাবেদ হাসান। গতকাল ঢাকা ও চট্টগ্রামে পৃথক অভিযানে তাদের আটক করা হয়েছে। তবে মূল অভিযুক্ত নুর উদ্দিনসহ তিনজন এখনও পলাতক। অন্যরা হলো ওই মাদ্রাসার ছাত্র সোনাগাজী পৌরসভার উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন শামীম ও আব্দুল কাদের। পলাতক তিনজনই এজাহারভুক্ত আসামি। নুর উদ্দিন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। নুরের গ্রামের বাড়ি চরচান্দিয়া গ্রামে। তার বাবা সোনাগাজী বাজারে হাতে তৈরি পাটসহ নানা জিনিসপত্র বিক্রি করে থাকেন। নুর সোনাগাজী মাদ্রাসায় ফাজিলে পড়ছে। সে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। অধ্যক্ষ গ্রেফতারের পর তার মুক্তির দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছিল, নুর সেই কর্মসূচির অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক। এলাকাবাসী ও রাফির স্বজনের দাবি, শুরু থেকে পুলিশ তৎপর হলে প্রধান অভিযুক্ত নুরসহ অন্যরা পালিয়ে যেতে পারত না। সূত্র জানায়, ঘটনার আগের রাতে নুর উদ্দিন এবং আলিম পরীক্ষার্থী নাসির উদ্দিনকে মাদ্রাসা ছাত্রাবাস থেকে বের হতে দেখা যায়। তাদের গতিবিধি ছিল সন্দেহজনক।

সুরতহাল প্রতিবেদন :রাফির মরদেহের সুরতহাল গতকাল সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- রাফির মাথার চুল কালো ও পোড়া। লম্বা অনুমান ১৮ ইঞ্চি। কপাল স্বাভাবিক। মুখম ল গোলাকার, উভয় কান, থুতনি, গলা, ঘাড়সহ পোড়া ও ঝলসানো। উভয় হাতের আঙুল পর্যন্ত রাউন্ড গজ-ব্যান্ডেজ; যা পোড়া ঝলসানো। গলার নিচ থেকে বুক, পেট, পিঠ, পায়ের পাতা পর্যন্ত পোড়া ঝলসানো। গায়ের রঙ ফর্সা, লম্বা অনুমান ৫ ফুট ২ ইঞ্চি। ফেসবুক আইডি ধরে চলছে তদন্ত :একটি ফেসবুক আইডির সূত্র ধরে পুলিশ মামলার তদন্ত এগিয়ে নিচ্ছে। ঘটনার আগের দিন শুক্রবার সকালে হামলাকারীরা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাদ্রাসা ভবন সরেজমিন রেকি করে। তারা এ সময় ভবন থেকে পালানোর বিভিন্ন দিক যাচাই করে। পরিদর্শনের পর কয়েকজন একসঙ্গে ভবনের সামনে মোবাইল ফোনে ছবি তোলে। এই ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে।

এদিকে রাফির বক্তব্যে উঠে আসা শম্পা নামের কোনো মেয়ের খোঁজ এখনও পায়নি পুলিশ। কেউ কেউ বলছেন, হয়তো অপরাধীরা পরিচয় গোপন করার জন্য এই নাম ব্যবহার করেছে। বোরকাপরিহিত চার হামলাকারী পুরুষও হতে পারে বলে তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একটি সূত্রের ধারণা। তবে কে রাফিকে ডেকে নিয়েছিল, সেটাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সোনাগাজী থানার ওসি কামাল হোসেন বলেন, ফেসবুকসহ নানা ক্লু ধরে অভিযুক্তদের শনাক্ত করার অনুসন্ধান চলছে। উৎস: সমকাল।

ad

পাঠকের মতামত