286634

‘বিশ্বাস করানো কঠিন ছিল শিশুর জন্মগত হৃদরোগ হতে পারে’

স্বাস্থ্য ডেস্ক।। ‘শিশুদের জন্মগত হৃদরোগ হতে পারে- এটা দেশে একসময় বলা চলে অজানা ছিল। শিশুর মা-বাবা ও স্বজনদের বিশ্বাস করানোও কঠিন ছিল যে, শিশুদের হৃদরোগ হতে পারে। এর কোনো চিকিৎসাও ছিল না। শুধু চিকিৎসা ও সচেতনতার অভাবে অনেক বাচ্চাই জন্মগত হৃদরোগে মারা যাচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে ভাবতাম, এসব বাচ্চার জন্য কিছু একটা করতে হবে। অনেক মুমূর্ষু বাচ্চার প্রাণ বাঁচিয়েছি। অপারেশন সফল হলে সবার আগে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। শিশুর মুখ ও মা-বাবার অভিব্যক্তি দেখে তখন মনে হয়, জীবনে এর চেয়ে সার্থকতা আর কিছু নেই।’

ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনে এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন অধ্যাপক ডা. ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুরুন নাহার ফাতেমা বেগম। চিকিৎসাক্ষেত্রে অবদান রাখায় এ বছর স্বাধীনতা পদক লাভ করেছেন তিনি। সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় ব্যক্তিগত কৃতিত্বের জন্য এ ধরনের সম্মাননা পাওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম। কোনো কাটাছেঁড়া ছাড়াই এ পর্যন্ত প্রায় ছয় হাজার শিশুর জটিল হৃদরোগের চিকিৎসা দিয়েছেন ডা. নুরুন নাহার। নবজাতক নীল হয়ে গেলে, শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ও অল্প ব্রেস্ট ফিডিং করার পরই হাঁপিয়ে গেলে তাকে দ্রুত শিশুরোগ বা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

১৯৮৭ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন নুরুন নাহার ফাতেমা বেগম। তিনি দেশের প্রথম পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট। তার স্বামী কর্নেল (অব.) আজহারউদ্দিন আহমেদ। দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে মার্জিয়া তাবাস্‌সুম ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমানে লন্ডনে কাজ করছেন ব্যাংকার হিসেবে। ছোট মেয়ে মাশিয়া মাইশা আহমদ ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছেন মেডিসিনের ওপর। নুরুন নাহারের জন্ম সিলেট জেলার মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার পাকশাইল গ্রামে।

ফাতেমা জানান, ১৯৯৭-৯৮ সালে সৌদি আরবের কিং সুলতান হাসপাতালে বিভিন্ন বিদেশি চিকিৎসকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তিনি শিশু হৃদরোগ চিকিৎসায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। পরে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৯৮ সালে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন শিশু হৃদরোগ বিভাগ, যা দেশের প্রথম শিশু হৃদরোগ চিকিৎসা কেন্দ্র। জন্মের ২-৩ দিনের মধ্যেই তিনি অপারেশন করেছেন, এমন শিশুর সংখ্যা অনেক। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত প্রায় ছয় হাজারের মতো ইন্টারভেনশন করেছেন তিনি।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফাতেমা আরও বলেন, স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া অত্যন্ত আনন্দের। এই পুরস্কার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালকে উৎসর্গ করছি। কারণ শুরু থেকে সেনাবাহিনীর সব সহকর্মীর যে সহযোগিতা পেয়েছি, তা এক কথায় অসাধারণ। তিনি বলেন, দেশে প্রতি হাজারে ২৫টি শিশু জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে জন্মায়। উন্নত বিশ্বে প্রতি হাজারে হৃদরোগ নিয়ে জন্মানো শিশুর সংখ্যা ৮-১০ জন। শিশুদের জন্য বিশেষায়িত জাতীয় কার্ডিয়াক সেন্টার তৈরির স্বপ্ন দেখেন তিনি। যেখানে অসচ্ছল মা-বাবার সন্তানরা বিনামূল্যে চিকিৎসা নিতে পারবে।

শিশু হৃদরোগ চিকিৎসার নতুন দিগন্ত উন্মোচনের জন্য ডা. ফাতেমাকে বলা হয় বাংলাদেশের ‘মাদার অব পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট’। শিশু চিকিৎসার আরেক দিকপাল অধ্যাপক এম আর খানের সঙ্গে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘চাইল্ড হার্ট ট্রাস্ট বাংলাদেশ’। ফাতেমা তার মা-বাবার নামে ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ওয়াদুদ-ময়মুন্নেছা ফাউন্ডেশন’। জন্মস্থান বড়লেখার পাকশাইল গ্রামে ফ্রি ফ্রাইডে ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন তিনি।

ডা. ফাতেমা বিশ্বের অন্তত ২১টি দেশ থেকে শিশু হৃদরোগ নিরাময়সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রযুক্তি দেশে নিয়ে এসেছেন। অক্লান্ত শ্রম ও প্রচেষ্টায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের শিশু কার্ডিওলজি বিভাগকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করে তুলেছেন। অতীতের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় প্রায় প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছে। কারণ বিষয়গুলো ছিল অত্যন্ত জটিল। তখন ভেবেছি, এই টেকনোলজি যদি শিখতে পারি এবং বাংলাদেশে নিয়ে যেতে পারি, তাহলে এমন অনেক শিশুকে বাঁচানো যাবে। যে কোনো মূল্যে এটা শিখতে হবে।’ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে গিয়ে নুরুন নাহার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেশ কিছু দিন আইসিইউতেও ছিলেন তিনি। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরত এসে ঠিক করেন, শিশুদের নিয়ে যে সাবজেক্ট, তা কখনও ছাড়বেন না। শিশুদের জন্য জীবন উৎসর্গ করার দৃঢ় সংকল্প নেন তিনি।

দেশে শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ তৈরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের আয়োজনে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন ডা. ফাতেমা। ২০১২ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঢাকায় সর্বপ্রথম মেলোডি পালমোনারি ভাল্‌ব প্রতিস্থাপন করা হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। তার মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃত ইন্টারভেশনগুলো হচ্ছে- বেলুন এট্রিয়াল সেপটোসটোমি, পেটেন্ট ডাকটাস আরটারিওসাস কয়েল অকলুশন, এট্রিয়াল সেপটাল ডিফেক্ট ডিভাইস ক্লোজার, ভেট্রিকুলার সেপটাল ডিফেক্ট ডিভাইস ক্লোজার, পেটেন্ট ডাকটাস আরটারিওসাস ডিভাইস ক্লোজার, মাসকুলার ভেট্রিকুলার সেপটাল ডিফেক্ট ডিভাইস ক্লোজার, করোনারি ফিসটুলা কয়েল অকলুশন, ভেট্রিকুলা সেপটাল ডিফেক্ট ডিভাইস ক্লোজার, পেটেন্ট ডাকটাস আরটারিওসাস ডিভাইস ক্লোজার ইত্যাদি।

ডা. ফাতেমা বলেন, ২০০০ সালের ঘটনা। একটি নবজাতক শিশুকে তার কাছে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। শিশুটির বাবা পুরান ঢাকার একজন ব্যবসায়ী। তখনও শিশুটির নাম রাখা হয়নি। সারা শরীর নীল হয়ে গেছে। বুঝতে পারি, ওর সমস্যাটা হচ্ছে ‘ট্রান্সপজিশন অব গ্রেট আর্টারিজ’ বা রক্তনালির সমস্যা। দ্রুত বিশেষ ব্যবস্থায় ওর হার্টের মধ্যে ছিদ্র করে দিই। এতে বেঁচে যায় শিশুটি। মিলেনিয়াম শুরুর সঙ্গে মিল রেখে আমিই ওর নাম রাখি শতাব্দী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের সন্তানের হার্টের একটি রক্তনালি ছিল না। আরেকটি ছিল প্রায় বন্ধ। দেশে তখন এসবের চিকিৎসাও ছিল না। ওই শিশুর চিকিৎসাও তিনি করেন। এভাবে শতশত শিশুর প্রাণ বাঁচিয়েছেন ডা. ফাতেমা। উৎস: সমকাল।

ad

পাঠকের মতামত