285045

দৃষ্টিহীন নাসিমা এইচএসসি পরীক্ষার টেবিলে

নিউজ ডেস্ক।। অদম্য মেধাবী দৃষ্টিহীন নাসিমা আক্তার। প্রাথমিক সমাপনী, জুনিয়র সার্টিফিকেট এবং সবশেষ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষায় জিপিএ ৪.৬৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয় সে। এবার উচ্চ শিক্ষার আশায় গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার পিয়ার আলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে দৃষ্টিহীন নাসিমা। এবার শ্রুতিলেখকের সাহায্যে এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র শ্রীপুর বীর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সরকারি কলেজ থেকে আজ সোমবার পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে মেধাবী এই শিক্ষার্থী।

কেন্দ্রটির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অধ্যাপক নুরুল ইসলাম জানান, প্রথম দিন সে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। সে দৃষ্টি প্রতিবন্ধি হওয়ায় তাকে শ্রুতিলেখকের সুযোগ দিয়ে তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহেনা আকতার বলেন, নাসিমা প্রতিবন্ধকতা ভেদ করে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার একটি উদাহরণ। সে একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধি হয়েও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাঠদানে অংশ নিয়েছে। যদিও তার জন্য আলাদা শিক্ষা পদ্ধতি ছিল। তার অদম্য ইচ্ছার কারণে সে লেখাপড়ায় এগিয়ে যাচ্ছে।

নাসিমার এগিয়ে চলা : সময়টা ২০০৪ সাল। বাবা বারেক মিয়া ও মা ফিরোজা বেগম এলাকার কিছু লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে মেয়ের দৃষ্টি ফেরার আশায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কেল্লার মাজারের বাৎসরিক ওরসে নিয়ে যান দৃষ্টিহীন শিশু নাসিমা আক্তারকে। ভালো গান গাইতে পারে জেনে সেখানে উপস্থিত কিছু লোকের অনুরোধে গান ধরেন নাসিমা। তার গানের সুরে শুনে মুগ্ধ হয়ে যান সকলেই।

এ সময় তাদের মধ্য থেকে এগিয়ে আসেন মঞ্জু সমাদ্দার নামে এক ভদ্রলোক। দৃষ্টিহীন নাসিমার প্রতিভা ধরা দেয় তার কাছে। দৃষ্টিহীন নাসিমাকে পড়ালেখা করানো জন্য ঢাকার একটি মিশনারিজ স্কুলে ভর্তি করার প্রস্তাব দেন বাবা বারেক মিয়াকে। প্রস্তাবে অবাক হন বারেক মিয়া। দৃষ্টিহীনরা কী পড়তে পারে! বাড়িতে এসে সংসারের অভাব ও দারিদ্রতা কথা চিন্তা করে দৃষ্টিহীন নাসিমাকে তুলে দেন মঞ্জু সমাদ্দারের হাতে। পরে তাকে ঢাকার একটি মিশনারিজ স্কুলে ভর্তি করান। শুরু হয় নাসিমার আলোকিত জীবনের নতুন এক অধ্যায়।

এক ভাই, দুই বোন, বাবা ও মাকে নিয়ে নাসিমাদের বাড়ি গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের সিংদীঘী গ্রামে। বাবা এক সময় কাঁচামাল বিক্রির ব্যবসা করলেও এখন আর কাজ করতে পারেন না। অনেক কষ্ট করে সন্তানদের লেখা করাচ্ছেন। আর নাসিমার ভর্তির পর তাকে কলেজের পক্ষ থেকে সকল ধরনের সহযোগিতা করেছেন কলেজের শিক্ষকরা। আর সহপাঠীরা নাসিমাকে বাড়ি থেকে কলেজে আনা নেওয়ায় সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন।

গান পাগল নাসিমা : জন্মের পর থেকে রেডিও টেলিভিশনে গানের শব্দ হলে থেমে যেতেন নাসিমা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গানের প্রতি আসক্তি আরও বেড়ে যায়, শুরু হয় গান গাওয়া। অভাব আর দারিদ্র্যতার কারণে কোনো ওস্তাদের কাছে গানের তালিম নিতে পারেনি। শুনে শুনে গান গায় সে। স্কুল প্রতিযোগিতায় দুই বার গান গেয়ে সেরা পুরুস্কার জেতার অভিজ্ঞতাও রয়েছে দৃষ্টিহীন নাসিমার। এখন তার গানের প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন এলাকায়। দেশাত্মবোধক, নজরুলগীতি, রবীন্দ্র সংগীতে রয়েছে তার ব্যাপক আগ্রহ। কারো সহযোগিতা পেলে গানের কোনো ওস্তাদের নিকট তালিম নিতে চায় সে।

নাসিমার স্বপ্ন আইনজীবী হওয়া : নাসিমার মনের ভিতরে শুরু হয়েছে স্বপ্নের বীজ বোনা। তার মনের লালিত স্বপ্ন অনুযায়ী সে লেখাপড়া করে আইনজীবী পেশাকে বেছে নিতে চায়। এলাকার অসহায় মানুষ যারা আইনের সহযোগিতা থেকে দূরে তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে একজন দৃষ্টিহীন হিসেবে এ পেশাকে জয় করতে চান।

নাসিমার বাবা বারেক মিয়া বলেন, সে ভিটামিন এ’র অভাবে দৃষ্টিহীন হিসেবেই জন্মগ্রহণ করে। পরে সংসারে অভাব ও দারিদ্র্যতার কারণে তাকে ভালো চিকিৎসা করাতে পারেননি। তবে নাসিমা ছোটকাল থেকেই খুবই মেধাবী। একটি বিষয় একবার শুনলেই সে স্মরণ রাখতে পারে। আগে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে নাসিমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকলেও এখন তাকে নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছেন বলে জানান তিনি।

পিয়ার আলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আহমেদুল কবির বলেন, সারা দেশে স্কুল পর্যায়ে যখন বিনামূল্যে বই বিতরণ আনন্দ একযোগে উপভোগ করে তখন দৃষ্টিহীন নাসিমারা এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। নাসিমা খুবই মেধাবী, পড়াশোনার প্রতি তার প্রচুর আগ্রহ।

তবে শ্রেণিকক্ষের বাইরে পড়াশোনার ব্যবস্থা না থাকায় পুরোপুরি ক্লাসে শিক্ষকদের পাঠদানের উপর নির্ভর করতে হয়েছে তাকে। কলেজের পক্ষ থেকে নাসিমার ক্লাস ও মাসিক পরীক্ষার জন্য শ্রুতি লেখকের ব্যবস্থা সব সময় করা হয়েছে।

পিয়ার আলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ একেএম আবুল খায়ের বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি নাসিমাকে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে লেখাপড়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সে প্রতিদিনই কলেজে নিয়মিতভাবে পাঠদানে অংশ নেয়। শিক্ষাবোর্ডের অনুমতি সাপেক্ষে তাকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি, সে ভালো ফলাফল করবে।’ উৎস: দৈনিক আমাদের সময়।

ad

পাঠকের মতামত