279115

নিউজিল্যান্ডে হামলাকারীর আসল টার্গেট কি তুরস্ক ও এরদোগান?

ডেস্ক রিপোর্ট।।  নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ শহরের একটি মসজিদে মুসল্লিদের ওপর বর্বরোচিত এবং নৃশংস হামলার ঘটনায় সারা বিশ্ব যখন শোকে আচ্ছন্ন তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু বিবৃতি আমার দৃষ্টি কাড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ইনফিনিটিচান নামের একটি ওয়েবসাইট এ নামবিহীন একটা লেখা ছাপানো হয়। এছাড়াও প্রকাশ করা হয় ৭৮ পৃষ্ঠার এক বিশাল ম্যানিফেস্টো যেখানে ইসলাম বিদ্বেষী, অভিবাসন বিরোধী প্রচুর কথাবার্তা লেখা আছে।

ওই ওয়েবসাইটের পোস্টে আরো বলা হয় আক্রমণকারী আজ শুক্রবার মসজিদে আক্রমণ করবে এবং এটা সে করবে ফেইসবুক লাইভে গিয়ে। পরে দেখা গেছে যে সে তাই করছে। আক্রমণকারীর প্রচার করা বিবৃতিতে দেখা যায় তার আক্রমণের শিকার মুসলমানরা হলেও মূল টার্গেট তুরস্ক, এর প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং ইউরোপে বসবাসকারী তুর্কি জনগোষ্ঠী। বর্ণবাদী অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত হামলাকারী ‘ব্রেনটন ট্যারেন্ট’ নামক সন্ত্রাসী দুই মসজিদে হামলা করে ৫০ জন মুসলমানকে হত্যা করে।

এই হামলা হয়তোবা একটা বড় কোন পরিকল্পনার অংশ হতে পারে। হামলাকারীর বন্দুক এবং ম্যাগাজিনের উপরে সাদা কালি দিয়ে লিখিত নাম ও তারিখের দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যায়, সে উসমানীয় খলিফাদের ইতিহাস খুব ভালোভাবে অধ্যয়ন করেছে।  তার বন্ধুকের ওপর আছে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুরাদকে হত্যাকারীর নাম। আছে উসমানীয় এবং সেলজুকদের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী অনেকের নাম।

শুধু উসমানীয় সম্রাজ্যই নয় উমাইয়াদের বিরুদ্ধেও তার হিংসা ও আক্রোশ প্রকাশ পায় ওই লেখায়। সর্বশেষ বর্তমান তুরস্ক, তুর্কি জনগণ এবং তাদের নেতাও এই হামলাকারীর আক্রোশের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।

কী আছে ওই ম্যানিফেস্টোতে? : হামলার আগে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং একটা অনলাইন পোর্টাল থেকে তার প্রচার করা ৭৮ পৃষ্ঠার ম্যানিফেস্টো পড়লে বুঝা যায় এই হামলা অনেক বড় পরিকল্পনার অংশ। ওই ম্যানিফেস্টোর ‘তুর্কিদের প্রতি’ শিরোনামের অংশে তুরস্কের ইউরোপিয়ান অংশে বসবাসকারী তুর্কিদের হত্যা করার হুমকি দেয়া হয়। লেখাটি হুবহু এখানে তুলে ধরছি:

“আমরা কনস্টান্টিনোপলের (ইস্তানবুল) জন্য আসতেছি এবং আমরা ওই শহরের প্রতিটি মসজিদ এবং মিনার ধ্বংস করে দেব। হাজিয়া সোফিয়াকে মিনার থেকে মুক্ত করা হবে এবং কনস্টান্টিনোপল ন্যায় ভাবে আবার সত্যিকার খ্রিস্টান হবে।

নিজের ভূমিতে ফিরে যাও, এখনো সময় আছে।” : “তোমরা বসফরাসের পূর্ব পার্শ্বে নিজেদের ভূমিতে শান্তিতে বাস করতে পারো। তখন হয়তো তোমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু যদি তোমরা ইউরোপের ভূমিতে বাস করার ইচ্ছা পোষণ করো বা বসফরাসের পশ্চিমে যে কোনো জায়গায়। আমরা তোমাদেরকে হত্যা করবো এবং তোমাদেরকে তেলাপোকার মতো আমাদের ভূমি থেকে তাড়িয়ে দেব। আমরা কনস্টান্টিনোপলের জন্য আসতেছি।”

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগানকে হুমকি দিয়ে লেখা অংশে বলা হয়, ‘এরদোগান আমাদের লোকদের সবচেয়ে পুরাতন শত্রুদের একজন এবং তিনি ইউরোপের সবচেয়ে বড় ইসলামিক গ্রুপের নেতা।’

ইস্তানবুল কেন গুরুত্বপূর্ণ? : তুরস্কের সবচেয়ে বড় নগরী ইস্তানবুল। এই শহরটির বুক চিরে বয়ে গেছে সবুজ পানির বসফরাস প্রণালী। প্রণালিটির পূর্ব অংশ এশিয়া আর পশ্চিম অংশ ইউরোপের মধ্যে। শহরের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস ধারণ করে আছে এই ইউরোপিয়ান অংশ।

ইস্তানবুলের পুরোনো নাম কন্সটান্টিনোপল। এছাড়া এটি বাইজান্টিয়াম পরিচিত ছিল। শহরটি ছিল রোমান সাম্রাজ্য, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য, ল্যাটিন সাম্রাজ্য ও উসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী। খ্রিস্টপূর্ব ৬৬০ সালে ম্যাগারের রাজা নিসোসের পুত্র বাইজাস কর্তৃক প্রতিষ্ঠা হয় বাইজান্টিয়াম শহর। ৩২৪ খ্রিষ্টাব্দে শহরটি সম্রাট কন্সটান্টাইন কর্তৃকপুনরায় উদ্বোধন করা হয়।

৩৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১১ তার নামে এটির নামকরণ করা হয় কন্সটান্টিনোপল। ১২ শতকে এটি ছিল ইউরোপের সর্ববৃহৎ ও সর্বাপেক্ষা ধনী শহর। ৩৬০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি কন্সটান্টিনোপলে তৈরি করা হয় সে সময়ের সর্ববৃহৎ গির্জা। পরবর্তীতে মধ্যযুগের শুরুতে ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে সেই গির্জার জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা হয় হাজিয়া সোফিয়া নামে একটি অর্থোডক্স গির্জা।

১৪৫৩ সালে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ যিনি সুলতান ফাতেহ (বিজয়ী সুলতান) নাম পরিচিতি তিনি ইস্তান্বুল বিজয় করার পর গির্জাটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। গির্জায় যোগ করা হয় ৪টি মিনার এবং মিম্বার। বাকি সবই অক্ষত থাকে। ওসমানীয় সালতানাতের পতনের পর আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্কের সময় থেকে হাজিয়া সোফিয়া শুধু একটি মিউজিয়াম হিসেবে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয়।

এখন মুসলমানরা এটাকে আবার মসজিদ হিসেবে খুলে দেয়ার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে অন্যদিকে ইউরোপিয়ান খ্রিস্টানদের পক্ষ থেকে এটিকে গির্জা হিসেবে খুলে দেয়ার দাবি অনেকদিনের। নিউজিল্যান্ডে মজসিদে হামলাকারী তার ম্যানিফেস্টোতে ইস্তানবুলের ইউরোপীয়ান অংশকে তুর্কি মুক্ত তথা মুসলমানশুন্য করার প্রত্যয় ব্যাক্ত করে। একইসাথে হাজিয়া সোফিয়াকে খ্রিস্টানদের কাছে ফেরত দেয়ার দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করে।

এখানেই তার হুমকি শেষ নয়। সে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোগানকে সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করে তাকে হত্যা করার হুমকি দেয়। ইউরোপ থেকে তুর্কি বংশোদ্ভূত সকলকে হত্যা করে ইউরোপকে ইউরোপীয়ানদের কাছে ফেরত দেয়ার কথাও বলা হয় মেনিফেস্টোতে। হামলাকারী গত বছর তুরস্ক সফরে এসে কিছু এলাকায় নজরদারি কার্যক্রম পরিচালনা করে।

তার কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে এটা সুস্পষ্ট যে নিউজিল্যান্ডের মসজিদের হামলা শুধু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। বরং ইউরোপ জুড়ে অভিবাসন বিরোধী, মুসলিম বিরোধী এবং নব্য নাৎসিবাদী যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তারই সামান্য নিদর্শন মাত্র। ইসলামের ইতিহাস, উসমানীয়, সেলজুক এবং উমাইয়াদের ব্যাপারে তার বিস্তারিত লেখা দেখলে যে কেউই বুঝবে যে হামলাকারী শুধু একজন ব্যাক্তি নয় বরং বড় একটা আন্দোলনের অংশ মাত্র।

এখনই এর মূলোৎপাটন করতে না পারলে আজ মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্ব উগ্রবাদী সন্ত্রাসের যে বীভৎস চেহারা দেখছে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ইউরোপও ডানপন্থী, শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদী সন্ত্রাসের আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে।

কিন্তু এখানে আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষণীয় যে, ইউরোপ এবং আমেরিকার যে মিডিয়া মুসলিম নামধারী কারো দ্বারা পরিচালিত কোনো হামলার কারণে সারা মুসলিম বিশ্বকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করতে উঠে-পরে লাগে সেই পশ্চিমা বিশ্ব, পশ্চিমা মিডিয়া এবং তাদের নেতারা নিউজিল্যান্ডের এই বর্বরোচিত হামলাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে আখ্যায়িত করলো না বা ইচ্ছা করেই বলেনি। পশ্চিমা বিশ্ব আর কত তাদের এই সন্ত্রাসীদেরকে ‘দুষ্ট বালক’ বলে তাদের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলোর সাফাই গাইবে? ​লেখক: সারওয়ার আলম, ডেপুটি চিফ রিপোর্টার-নিউজ পাবলিশার, আনাদলু এজেন্সি, তুরস্ক। উৎস: যুগান্তর।

ad

পাঠকের মতামত