278947

চিকিৎসক রাজনকে হত্যা করেছে স্ত্রী, দাবি পরিবারের

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সহকারী অধ্যাপক রাজন কর্মকারের (৩৯) রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। তিনি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের মেয়ে ডা. কৃষ্ণা মজুমদারের স্বামী। রাজনের পরিবার ও চিকিৎসক সহকর্মীদের অভিযোগ- স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি তার। হত্যা করা হয়েছে তাকে। ময়নাতদন্তের দাবি ও প্রকৃত তদন্ত চেয়ে স্কয়ার হাসপাতালে বিক্ষোভ করেন তার সহকর্মীরা। তবে তার শ্বশুরপক্ষের ময়নাতদন্ত করতে অনীহা থাকলেও সহকর্মীদের দাবির মুখে মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ডা. রাজন কর্মকারের মৃত্যুকে ‘অস্বাভাবিক’ উল্লেখ করে শেরে বাংলা থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন তার মামা সুজন কর্মকার। রোববার সন্ধ্যার পর বাদী হয়ে অভিযোগটি করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি আরো জানান, রাজনের মৃত্যুকে আমরা কোনোভাবেই স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে মেনে নিতে রাজি নই। তাই আমরা তার মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত চাই। সুজন কর্মকার বলেন, লাশের ময়নাতদন্ত করতে দিতে হবে। কৃষ্ণা রাত ২টার দিকে রাজনের মাকে মোবাইল ফোনে বলেছিল, আপনার ছেলে মারা গেছেন, আমি আপনাদের দেখে নেব, আমি সুইসাইড করবো। আপনাদের শান্তিতে থাকতে দেব না।

শেরে বাংলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানে আলম বলেন, বিকেল ৫টায় স্কয়ার হাসপাতাল থেকে লাশ উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। রাজন কর্মকারের মামা সুজন কর্মকার বাদী হয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। আমরা অভিযোগ গ্রহণ করেছি। হত্যার অভিযোগের বিষয়টি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর নিশ্চিতভাবে বলা যাবে।

রাজনের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার এখলাসপুরে। তার বাবা সুনীল কর্মকার ও মা খুকু রানী কর্মকার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পড়ালেখা করেছেন তিনি। বিএসএমএমইউর ওরাল অ্যান্ড ম্যাপিলোফেসিয়াল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন রাজন। স্ত্রী ডা. কৃষ্ণা মজুমদারও একই হাসপাতালের জেনারেল সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তাদের। ইন্দিরা রোডের বাসায় থাকতেন তারা। বাবা-মা থাকেন গ্রামের বাড়িতে। এদিকে হত্যার অভিযোগ তুলে বিচার দাবিতে রোববার বিকেলে নোয়াখালীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবরোধ করে এলাকাবাসী। তবে রাজনের পরিবারের অভিযোগের ব্যাপারে খাদ্যমন্ত্রীর মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি তাকে।

রাজনের সহকর্মীরা জানিয়েছেন, রোববার ভোররাতে ইন্দিরা রোডের বাসা থেকে রাজনকে মৃত অবস্থায় পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যান তার স্ত্রী ও শ্বশুরপক্ষের লোকজন। পরে স্ত্রীসহ স্বজনরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই রাজনের মৃতদেহ নিয়ে যেতে চাইলে বাধা দেন বিএসএমএমইউর তার সহকর্মী চিকিৎসকরা। ময়নাতদন্তের দাবি তোলেন তারা। সহকর্মীরা বলেন, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এর আগেও শরীরে আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন রাজন। তার মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন তারা।

রাজনের সহকর্মী বিএসএমইউর চিকিৎসক অর্ণব বড়ূয়া জানান, শনিবার রাত ১২টায় ডা. রাজন মোহাম্মদপুরের সাতমসজিদ রোডের আল-মানার হাসপাতালে রোগীর অপারেশন শেষে বাসার উদ্দেশে বের হন। ভোর সাড়ে ৫টায় তিনি এক সহকর্মীর মাধ্যমে জানতে পারেন রাজন মারা গেছেন। স্কয়ার হাসপাতালে আছেন। এরপরই তিনি ছুটে যান স্কয়ারে। সেখানে গিয়ে কৃষ্ণা মজুমদার, কৃষ্ণার বোন, ভগ্নিপতি এবং মন্ত্রী সাধন মজুমদারকে দেখতে পান। তখন রাজনের লাশ মরচ্যুয়ারির সামনে রাখা ছিল। খবর পেয়ে পর্যায়ক্রমে বিএসএমএমইউর চিকিৎসকরা আসেন হাসপাতালে। কৃষ্ণাসহ তার স্বজনরা রাজনের মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে দাবি করতে থাকেন।

দুপুর ১২টার দিকে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ বুঝে নিতে যান কৃষ্ণা ও তার স্বজনরা। এ সময় বাধা দেন বিএসএমএমইউর চিকিৎসকরা। তারা বলেন, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। তাকে হত্যা করা হতে পারে।’ রাজনের পরিবারের সদস্যদেরও একই অভিযোগ। রাজনের মা খুকু রানী কর্মকার সমকালকে বলেন, ‘হত্যা করা হয়েছে তার ছেলেকে।

রাজনের সহকর্মী বিএসএমএমইউর চিকিৎসক শাহ নেওয়াজ বারী জানান, রাজনের শ্বশুরবাড়ির লোকজন লাশের ময়নাতদন্ত করে দিতে চাচ্ছিল না। পরে আমাদের দাবির মুখে ময়নাতদন্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। আমরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই। কারণ এর আগেও রাজন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। সে সময় তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছিলাম আমরা। বিএসএমএমইউর ওরাল অ্যান্ড ম্যাপিলোফেসিয়াল বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী বিল্লুর রহমান বলেন, ‘বিএসএমএমইউর সব চিকিৎসক ও শিক্ষার্থী এখানে এসেছে। সবার দাবি ঘটনার একটি সুষ্ঠু তদন্ত হোক।’

বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ূয়া জানান, তিনি রাজনের মৃত্যুর সংবাদ শুনেছেন। রাজন বিএসএমএমইউর চিকিৎসক ছিলেন। চিকিৎসকদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। তার মৃত্যু সহকর্মীদের ব্যথিত করেছে। তার সহকর্মীরা মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটনের দাবি জানিয়েছেন। রাজনের বাবা ও মামা তার কাছে এসেছিলেন। রাজনকে হত্যা করা হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেছেন। এ কারণে বিএসএমএমইউর পক্ষ থেকেও তার লাশ ময়নাতদন্তের দাবি জানানো হয়েছে।

স্কয়ার হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, রাত ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে ডা. রাজনকে আমাদের এখানে নিয়ে আসেন পরিবারের সদস্যরা। এরপর আমরা তাকে মৃত ঘোষণা করি। এখানে নিয়ে আসার পর তার লাইফের কোনো সাইন পাইনি। ইসিজি করা হয়, সেটি স্ট্রেট লাইন ছিল। তার বডিতে কোনো ইনজুরি ছিল না। হার্ট ব্লক হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে নোয়াখালীতে রাজনের গ্রামের বাড়িতে মাতম চলছে। রাজনকে হত্যার অভিযোগ তুলে বিচারের দাবিতে এলাকাবাসী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনাপুর-বেগমগঞ্জ এলাকার মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। রাজনের ছোট ভাই রাজীব কর্মকার অভিযোগ করেন, স্ত্রীই রাজনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ডাক্তার ও তার বন্ধুবান্ধবরা সবাই বলছেন, এটি অস্বাভাবিক মৃত্যু। আমিও এটাই বিশ্বাস করি এবং এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।

রাজনের মা খুকু রানী কর্মকার জানান, রাজন-কৃষ্ণার দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। নানা কারণে রাজনকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হতো। বিয়ের বছর দেড়েক পর রাজনের মাথায় কাঠ দিয়ে আঘাত করেছিলেন কৃষ্ণা। খুকু রানী বলেন, আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে।

রাজন কর্মকারের মামা উত্তম কর্মকার বলেন, দেড় বছর আগে আমার ভাগিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। সে সময় তাকে প্রথমে পপুলার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে, সেখান থেকে সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেবার সে বেঁচে যায়। তখন, আমার বোন (রাজন কর্মকারের মা) খুকু রাণী কর্মকার তৎকালীন এমপি সাধন মজুমদারের কাছে আমার ভাগিনার প্রাণভিক্ষা চান। তখন এমপি সাহেব বলেন, ‘আপনার ছেলের দায়িত্ব আমি নিলাম।’ কিন্তু,আজ দেখা গেলো, আমার ভাগিনাকে পরিকল্পিতভাবে হত্য করা হয়েছে। আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।

ad

পাঠকের মতামত