276634

এক চুলা ১৩৫০ দুই চুলা ১৪৪০ টাকা করতে চায় তিতাস

নিউজ ডেস্ক।। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করলে শিল্প-কারখানা তালা দিয়ে চাবি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে রেখে যাবেন বলে হুশিয়ারি দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। গতকাল মঙ্গলবার দুটি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ভিত্তিতে শুনানির আয়োজন করে বিইআরসি। এতে দেশের শিল্পমালিকদের শীর্ষস্থানীয় সব সংগঠনের নেতৃবৃন্দও হাজির ছিলেন। শুনানিকালে তারা দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করেন।

প্রসঙ্গত, এর আগে দাম বৃদ্ধির শুনানিতে শিল্পমালিকদের বিভিন্ন সংগঠন প্রতিনিধি পাঠালেও এবারই প্রথম একসঙ্গে তিনটি সংগঠনের সভাপতি শুনানিতে উপস্থিত হন। এ সময় তারা বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি শিল্পের বিকাশকে শুধু বাধাগ্রস্তই করবে না, ধ্বংস করে ফেলবে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, এমনিতেই বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে (এসএমই) খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অথচ একটি দেশের শিল্পের মেরুদ- বলা হয়ে থাকে এ খাতকে। আমাদের দেশে যেসব উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে এক-দুই কোটি টাকা নিয়ে ব্যবসা করছেন, তাদের ক্ষেত্রে এক রকম নিয়ম। আর যারা ৫শ-৭শ কোটি টাকা বাগিয়ে নিয়েছেন, তাদের বেলায় ভিন্ন নিয়ম। এমন অসঙ্গতির পরও কিছু মানুষ সাহস করে ব্যবসায় আসছেন, থেকে যাচ্ছেন; নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু এভাবে জ্বালানির দাম বাড়ালে এসব উদ্যোক্তার পথে বসতে হবে। এটি বিকাশমান অর্থনীতির ধ্বংস ডেকে আনবে।

এদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেছেন, নতুন ৫শ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি এখনো আসেনি। বিইআরসি নিজেও জানে, আগামী এপ্রিলেও এ এলএনজি আসবে না। এর পরও অদৃশ্য ইশারায় বিইআরসি গ্যাসের দাম বাড়িয়ে পুনরায় নির্ধারণ করতে চাইছে। তিনি বলেন, হাইকোর্ট সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) থাকা না-থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, যে কমিশন ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে পারে না, সেই কমিশন থাকলেই কি, না থাকলেই কি জনগণ একদিন এমন প্রশ্নও তুলতে পারেন। শামসুল আলম আরও বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব অযৌক্তিক ও বেআইনি।

বিতরণ কোম্পানিগুলো লাভ করার পরও গ্যাসের দাম বাড়াতে চাইছে। বিইআরসি যে ভর্তুকি নির্ধারণ করেছে, সরকার তা না দিলে জ¦ালানি নিরাপত্তা তহবিলে অলস পড়ে থাকা ৭ হাজার ৫শ কোটি টাকা থেকে ঋণ দিয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলো চালানো যেতে পারে। সরকার বলছে, পর্যায়ক্রমে ৪ হাজার ৫শ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আসবে। কিন্তু এতে কি পরিমাণ ব্যয় বাড়বে, তাও ভোক্তাদের অবগত করা উচিত। কারণ যারা গ্যাস ব্যবহার করবেন তারাই যদি না জানেন, তা হলে কি করে দাম পরিশোধ করবেন? শুনানিতে বিদ্যুতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৩.১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯.৭৪ টাকা, সিএনজিতে ৩২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৮.১০ টাকা, প্রি-পেইড মিটারে ৯.১০ (ঘনমিটার) টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬.৪১ টাকা করার প্রস্তাব করেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড।

এ ছাড়া আবাসিকে এক চুলার বর্তমান দর ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩শ ৫০ টাকা, দুই চুলায় ৮শ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪শ ৪০ টাকা, সার উৎপাদনে প্রতি ঘনমিটার ২.৭১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮.৪৪ টাকা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৯.৬২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮.০৪ টাকা, শিল্পে ৭.৭৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪.০৫ টাকা, বাণিজ্যিকে ১৭.০৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪.০৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সব মিলিয়ে গড়ে ১০২.৮৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। তিতাস প্রথমে গড়ে ৬৬ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দিলেও সংশোধিত প্রস্তাবে বাড়তি দর অনুমোদনের আবেদন করেছে। প্রায় অভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানিও। বরিশাল, খুলনা বিভাগ ও ঢাকা বিভাগের আংশিক এলাকায় বিতরণের দায়িত্বে থাকা সুন্দরবন তাদের বিতরণ চার্জ ২৫ পয়সা থেকে বৃদ্ধি করে ১ টাকা ২৫ পয়সা করার আবেদন করেছে। তিতাস গ্যাসও বিতরণ চার্জ বাড়ানোর প্রস্তাবনা দিয়েছে। তাদের বর্তমান বিতরণ চার্জ ২৫ পয়সা।

এটি বাড়িয়ে চলতি অর্থবছরে ৫৩ পয়সা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৫ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে চলতি অর্থবছর শেষ হওয়ার পর প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে তিতাসের বিতরণ চার্জ বৃদ্ধি করাটাই যৌক্তিক হবে বলে মন্তব্য করেছে বিইআরসির মূল্যায়ন কমিটি। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোহম্মদ আলী খোকন বলেন, আমাদেরকে বাতাস দিয়ে টাকা নিয়ে যাচ্ছে তিতাস। দাম বৃদ্ধির পর আমরা বারবার বলেছি, আমাদের আঙ্গিনায় ইভিসি মিটার লাগিয়ে দেওয়া হোক। এতে করে আমরা প্রেশার অনুযায়ী গ্যাসের দাম দিতে পারব। কিন্তু তিতাস শুনছে না আমাদের কথা। আমাদের কি অপরাধ বুঝতে পারছি না। আমাদের যা গ্যাস দেওয়া হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি বিল নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেই আবার নতুন করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এমন অন্যায়ভাবে দাম বাড়ানো হলে আমরা শিল্প প্রতিষ্ঠানের চাবি বিইআরসির কাছে দিয়ে যাব। এ ছাড়া আমাদের কোনো উপায় থাকবে না। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক শিল্প ৪০ থেকে ৪৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করছে। এর নেপথ্যে আমাদের টেক্সটাইলস মিলের অবদান রয়েছে। আমরা দেশের ১৭ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করছি। নইলে এ পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যেত। গ্যাসের দাম বাড়ালে টেক্সটাইলস মিল যারপরনাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

শুনানিতে এফবিসিসিআইর সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, আমাদের এখানে একজন উদ্যোক্তা শিল্প-কারখানা করতে এলে জানতে পারছেন না, তার জ¦ালানি ব্যয় কত হবে। পৃথিবীর কোথাও এভাবে শিল্প-কারখানা করা হয় না। তিনি বলেন, সব দেশেই জ¦ালানি দরের পূর্বাভাস পাওয়া যায়, যা আমাদের এখানে পাওয়া যায় না। সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করে একটি যৌক্তিক জ¦ালানি দরের পূর্বাভাস দেওয়ার দাবি জানান শিল্প বণিক সংস্থার এই সভাপতি। বলেন, এতে করে একজন উদ্যোক্তা বুঝতে পারবেন, তার পণ্যের উৎপাদন খরচ কত হবে। তিনি বলেন, এখন আমরা উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশের দিকে ধাবিত হচ্ছি। এ জন্য শিল্প খাতে ৭০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। নতুন উদ্যোক্তারা এ বিনিয়োগ করবেন। কিন্তু এভাবে জ¦ালানির দর বৃদ্ধি করলে সেই বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণে সরকার সুনীতি গ্রহণ করলেও সরকারের স্বল্পমেয়াদি নীতি শিল্পসহায়ক নয়।

এসব দিকে নজর দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, শুধু দাম বাড়ানোর সময় আমাদের ডাকা হবে আর বিশ্ববাজারে দাম কমলে কমানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে না, এটি যথার্থ নয়। ২০১৯ সালে বিশ্বে গড় গ্যাসের মূল্য ছিল ৬ দশমিক ৯ ডলার এমএমবিটিইউ (ব্রিটিশ থারমাল ইউনিট)। গত কয়েক বছরে মজুরি ও অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে আমাদের ২৯ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেলে উদ্যোক্তারা দেউলিয়া হয়ে যাবেন; নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে না; কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির গণশুনানি হাস্যকর। তিতাস তাদের শেয়ারহোল্ডারদের ৩৫ শতাংশ মুনাফা দিচ্ছে। কিন্তু আমরা তো এক-দুই শতাংশও ব্যবসা করতে পারছি না। তারা কি করে সরকারশাসিত প্রতিষ্ঠান হয়ে এত বেশি মুনাফা দেয়? সিদ্দিকুর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম থেকে জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে এলএনজি।

অথচ এ গ্যাস ঢাকায় পৌঁছার আগেই ফুরিয়ে যাচ্ছে। শুনানিতে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সালেক সুফী বলেন, বিদ্যমান পাইপলাইনে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ করা যাবে না। আর সেই এলএনজি পাবেও না সুন্দরবন বিতরণ কোম্পানি। ফলে এলএনজি আসার অজুহাতে তাদের গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। বিইআরসি চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলামের সভাপতিত্বে শুনানিতে বিইআরসির সদস্যরাও অংশ নেন। উৎস: দৈনিক আমাদের সময়।

ad

পাঠকের মতামত