271419

‘আমি অসম্ভব সৌভাগ্যবান যে বেঁচে ফিরে এসেছি’

‘আমি অসম্ভব সৌভাগ্যবান যে আমি সেই জায়গা হতে বেঁচে ফিরে এসেছি। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে যে ছেলেটা আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল তার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। আমি জানি না এর কারণটা কি!’ নিজের ওপর হামলার এক বছর পরে এভাবেই কথাগুলো বললেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও লেখক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

গত বছরের ৩ মার্চ সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) মুক্তমঞ্চে হামলার শিকার হন এই জনপ্রিয় অধ্যাপক। নিজের ওপর হামলা প্রসঙ্গে ড. জাফর ইকবাল বলেন, ‘পৃথিবীতে খুব বেশি মানুষ নেই, যারা হত্যাকারী তাদের সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন। এটা আমার জন্য বড় অভিজ্ঞতা সেই ছেলেটিকে আমি সামনা সামনি কথা বলার সুযোগ পেয়েছি।’

এক বছর আগের এই ঘটনা ভুলে গিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে এই ঘটনার কোনো প্রভাব আমার ওপর পড়ে কিনা। আশ্চর্যজনক যে এই ঘটনার কোনো প্রভাব আমার ওপর পড়েনি এবং আমি দ্রুতই সুস্থ হয়ে গেছি।’

জনপ্রিয় সাহিত্যিক জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমার জন্য সারা দেশের মানুষ, দেশের বাইরের মানুষ, শিক্ষার্থীরা, নিজের শিক্ষার্থীরা অনেক দোয়া করেছেন ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। আমি তাদের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ এবং আমার মনে হয়েছে আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের জন্য তাদের এই যে ব্যাকুলতা তাই তাদের জন্য আমার কিছু করতে হবে। অন্যথায় আমার দায়িত্ব পালন হবে না। আমি সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

হামলার শিকার হয়েও বেঁচে যাওয়ায় নিজেকে সৌভাগ্যভাগ মনে করেন জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেক তরুণদেরকে, মুক্তমনা মানুষজনকে, ব্লগারদেরকে জঙ্গিরা মেরে ফেলেছে এবং তাদের অনেককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। আমাকেও মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু আমি অসম্ভব সৌভাগ্যবান যে আমি সেই জায়গা হতে বেঁচে ফিরে এসেছি।

আমি ওই ছেলেটির (হামলাকারী) সাথে দেখাও করেছি। তাকে জিজ্ঞেসও করেছি যে কেনো তুমি এই কাজ করার চেষ্টা করলে। আমি তার কাছ থেকে কোনো সঠিক উত্তর পাইনি। শুধু বুঝতে পেরেছি আমাদের দেশে এরকম অনেক মানুষ আছে, অনেক তরুণ আছে যাদেরকে বিভ্রান্ত করে দেয়া হয়। আর এই জন্য ধর্মটাকে বড় আকারে ব্যবহার করা হয়। তবে যারা এই কাজগুলো করে তাদের ওপর আমার রাগ আছে, কেনো তারা এই কাজগুলো করবে?’

জাফর ইকবাল আরো বলেন, যারা এ ধরনের কাজ করে তাদেরকে একটি কথাই বলবো- তোমরা যে ধর্মকে ব্যবহার করে এইভাবে কাজ করো এইটা ঠিক না। ‘‘আমি নিজে ধর্মগ্রন্থ পড়েছি সেখানে কিন্তু স্পষ্ট করে লেখা আছে ‘ইফ ইউ কিল অ্যা ম্যান, ইউ কিল হোল ম্যানকাইন্ড’। এতো বড় কথার পরও তুমি যদি এই ধরনের কাজ করার চেষ্টা করছ তা মোটেই ঠিক নয়।’

জাফর ইকবালের ওপর হামলার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দুই দিনব্যাপী উৎসবের রোবটিক প্রতিযোগিতার সমাপনী অনুষ্ঠান চলছিল। মুক্তমঞ্চে চলছে রোবোফাইট। জাফর ইকবালসহ শিক্ষকরা তখন সোফায় বসে ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন শতাধিক শিক্ষার্থীও।

বিকাল সোয়া ৫টা থেকে মঞ্চেও কয়েকজন শিক্ষার্থী উঠে আসেন। তাদের সাথে হামলাকারী ফয়জুর রহমান ওরফে ফয়জুলও (২৪) মঞ্চে উঠে। ঘড়িতে ৫টা ৪০ মিনিটের সময় পেছন থেকে সে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলা করে।

সেদিনের সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিশ্বপ্রিয় চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘রোদ এবং ওইদিন বিকালে কয়েক ফোটা বৃষ্টির কারণে মুক্তমঞ্চের উপরে ছাতার নিচে অধ্যাপক জাফর ইকবালসহ, বিভাগের অন্যান্য সিনিয়র শিক্ষক বসেছিলেন। হঠাৎ ছাতার নিচ থেকে একটা শব্দ হলো, তারপর দেখতে পাই জাফর স্যার উঠে দাঁড়ালেন এবং স্যার এর মাথার দিক থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। ওই মুহূর্তে পাশেই ছিল পুলিশের ভাড়া হিসেবে ব্যবহার করা একটি মাইক্রো। স্যারকে আমরা সেখান থেকে উদ্ধার করে দ্রুতই সেই গাড়িতে করে ওসমানী মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাই।’

প্রসঙ্গত, জাফর ইকবালের ওপর হামলার পরে তাৎক্ষণিক তাকে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১১ দিন চিকিৎসার পর পূর্ণ সুস্থ হয়ে ১৪ মার্চ তিনি নিজ ক্যাম্পাসে ফেরেন।

তার ক্যাম্পাস ফেরা উপলক্ষে সেই মুক্তমঞ্চেই ওইদিন বিকালে সাদাসিধে কথা শিরোনামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিক্ষার্থীরা। যেখানে বক্তব্য দেন জাফর ইকবাল। আর হামলার পরপরই শিক্ষার্থীরা হামলাকারীকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেন। ঘটনার পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন বাদী হয়ে জালালাবাদ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় ফয়জুরসহ ৬ জনকে আসামি করে গত বছরের ৬ মে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তৎকালীন জালালাবাদ থানার অফিসার ইনচার্জ শফিকুল ইসলাম স্বপন জানান, এ ঘটনার পরদিন সন্ত্রাসবিরোধ আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়, মামলায় হামলাকারী ফয়জুলসহ ৬ জনকে আসামি করা হয়।

বাকি আসামিরা হলেন- ফয়েজের বাবা হাফেজ মাওলানা আতিকুর রহমান ও মা মিনারা বেগম, মামা মো. ফজলুর রহমান, ফয়েজের ভাই এনামুল হাসান এবং ফয়েজের বন্ধু মো. সোহাগ মিয়া। পরবর্তীতে গতবছরের মে মাসের ৬ তারিখ এই মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়।

মামলার বাদী রেজিস্ট্রার ইশফাকুল হোসেন ইউএনবিকে বলেন, স্যারের মতো একজন মানুষের ওপর হামলা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। যেহেতু মামলাটি বিচারাধীন আছে ওইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক জায়গা থেকে কথা বলা উচিৎ হবে না। তবে আশাবাদী খুব দ্রুতই এই মামলার সুষ্ঠু বিচারিক রায় কার্যকর হবে।

প্রসঙ্গত, অধ্যাপক জাফর ইকবাল পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ১৯৭৫ ও ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে ১৯৮২ সালে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে গবেষণা শুরু করেন।

১৯৮৮-১৯৯৪ পর্যন্ত তিনি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চ (বেলকোর)-এ গবেষণা করেন। ওই বছরের ডিসেম্বরে দেশে ফিরে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন তিনি।

শাবিপ্রবিতে তার দীর্ঘ এ কর্মজীবনে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য, একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য, শাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতির পদে আসীন ছিলেন। তিনি একাধারে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবং ইলেক্ট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।

ad

পাঠকের মতামত