238774

শিশুকে জ্বলন্ত চুলায় ফেলে দিলেন বাবা, এরপর…

লিওশা তার শৈশবের অনেকটা সময়ই কাটিয়েছেন বিশ্বের নানা ক্লিনিকে ক্লিনিকে। কেন? কারণ তার বাবা তাকে পুড়িয়ে মারার জন্য আগুনে ফেলে দিয়েছিলেন।লিওশা দৈবক্রমে বেঁচে গেছেন, কিন্তু সেই আগুনে পোড়ার বীভৎস চিহ্ন তার সারাদেহে এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।‘দেখুন, আমার গায়ের চামড়াটা অনেকটা সমুদ্র সৈকতের বালুর মতো’ – মৃদু হেসে বলছিলেন ১৬ বছরের লিওশা।পূর্ব সাইবেরিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে লিওশা। ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখে আসছেন – তার চারপাশে শুধু দারিদ্র্য, আর সবাই ডুবে আছে মদের নেশায়। তার নিজের ভাগ্যও নির্ধারণ করেছে এই মদ।সেটা ২০০৫ সালের কথা । নতুন বছর উদযাপনের সময় তার বাবা নেশায় চুরচুর অবস্থায় তার দুই শিশু সন্তানকে কাঠ-পোড়ানোর চুলায় ফেলে দিয়েছিলেন। দু’জনের মধ্যে একজনের বয়েস ছিল মাত্র ১৪ মাস। সে আগুনে পুড়ে মারা যায়। তবে দু’বছরের লিওশাকে তার মা কোনোমতে আগুন থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন।লিওশা প্রাণে বেঁচে যান কিন্তু তার মাথা, কাঁধ, বাহু এবং ফুসফুস গুরুতরভাবে পুড়ে যায়। সারা দেহে তৈরি হয় বীভৎস ক্ষত ।

পত্রিকায় খবর হয়েছিল লিওশার ঘটনা—আমি লিওশার ঘটনাটা জানতে পেরেছিলাম পত্রিকায় পড়ে। আমার নানী প্রতি সপ্তাহেই বাজার করতে যেতেন, আর ফিরে আসার সময় সাথে করে নিয়ে আসতেন বেশ মোটা একটা পত্রিকা – যার নাম ছিল আর্গুমেন্টস এ্যান্ড ফ্যাক্টস বা ‘যুক্তি এবং সত্য।’আমার মনে আছে, সেই পত্রিকায় একটা খবর পড়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। সেটা ছিল একটা ছোট্ট ছেলের গল্প, যে জ্বলন্ত চুলোর মধ্যে পড়ে গিয়ে মারাত্মকভাবে আগুনে পুড়ে গেছে। এরপর থেকে আমার গনগনে আগুন জ্বলতে থাকা রাশিয়ান চুলোর দিকে তাকাতে ভয় করতো।

দশ বছর ধরে চিকিৎসা চলেছিল লিওশার—এটাও মনে আছে, লিওশার চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্য চেয়ে পত্রিকায় আবেদন জানানো হয়েছিল।লিওশার মা ছেলের পরিচর্যা করে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। তাই তাকে এর পর বুরিয়াটিয়া থেকে সরিয়ে মস্কোতে অন্য একটি পরিবারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।তার চিকিৎসায় সময় লাগে পুরো এক দশক। এর মধ্যে ছিল ত্বক প্রতিস্থাপন, শল্যচিকিৎসা, এবং তার আরোগ্য।এই চিকিৎসার জন্যেই লিওশার বয়স ১৬ হতে হতেই তার প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ঘোরা হযে যায়।আমি সুইজারল্যান্ডে ছিলাম, তা ছাড়া গেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, লিথুয়ানিয়া -এরকম অনেক দেশে’-বলছিলেন লিওশা।‘সবই আমার এই আগুনে পোড়ার চিকিৎসার জন্য। অনেকগুলো ক্লিনিক এবং ক্যাম্পে আমি গেছি।’

নতুন চোখে জীবনকে দেখা—–লিওশা বলছিলেন, ‘একটা শারীরিক অক্ষমতা বা সমস্যা আপনার মধ্যে জীবনকে দেখার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী তৈরি করতে পারে। আপনার সামনে নতুন সুযোগও খুলে দিতে পারে।’‘কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো আপনি যেন এটা হতে না দেন যে আপনার সমগ্র জীবন একে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। তাহলে কিন্তু সেটা হবে আপনার আত্মার মৃত্যু’ – বলছিলেন লিওশা।শিশু হিসেবে ওই ভয়াবহ ঘটনার পর লিওশার জীবন কেমন ছিল তা কল্পনা করাও কঠিন।

কেমন ছিল লিওশার শৈশব?—এরকম বীভৎস ক্ষত নিয়ে তার জন্য স্কুলে যাওয়াটাই বা কেমন ব্যাপার ছিল? কারণ এটা তো সত্যি কথা যে – শিশুরা এমনকি বড়রাও কখনো কখনো খুব নিষ্ঠুর হতে পারে।‘আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমি অন্য লোককে ঘৃণা করতাম’-স্বীকার করলেন লিওশা।‘আমার মনে হতো যে তারা আমাকে একটা জানোয়ার বা ওই রকম কিছু বলে মনে করতো।’

মনেবিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ—-‘একটা পর্যায়ে আমি সাইকোলজি বা মনোবিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লাম। এর চর্চার মাধ্যমে আমি সত্যিই অনেক কিছুর অর্থ ভালোভাবে বুঝতে শিখলাম। তখন আমার মধ্যে এই অন্যদের প্রতি ঘৃণা তৈরি হয়েছিল – তা দূর হয়ে গিয়েছিল।’যতই দিন পার হতে লাগলো লিওশার চেহারা ততই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করলো।‘আমাকে দেখে মানুষের মধ্যে দু’রকম প্রতিক্রিয়া হতো। লোকে অজানা কিছু দেখলে হয় ঘাবড়ে যায় এবং তাকে অপছন্দ করে, অথবা তারা কৌতুহলী হয়ে ওঠে এবং তার সাথে পরিচিত হতে চায়।’আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – এই ট্রাজেডি তার পুরো জীবনকেই বদলে দিয়েছে কিনা। তিনি শুধু কাঁধ ঝাঁকালেন।‘এটা তো আমার ইচ্ছেয় ঘটেনি। আমি ছোট ছিলাম। যা হবার হয়ে গেছে। যদি এর অন্য কোন পরিণতি হতো – তাহলে আমি হয়তো মারা যেতাম, অথবা হয়তো বুরিয়াটিয়াতেই থেকে যেতাম, সেখানেই জীবন কাটতো আমার। আর কি?’আগুন দেখে ভয় পান না লিওশা, পৌরাণিক পাখী ফিনিস্কের গল্প অনুপ্রাণিত করে তাকে

কাউকেই দোষ দিতে চান না লিওশা—লিওশা আমাকে বিস্মিত করে, আমি বুঝে উঠতে পারি না কি বলবো। সে নিজেকে নিয়ে এবং তার চারপাশের দুনিয়া নিয়ে হাসে, সে কাউকে দোষ দিতে চায় না। সে ভয় পায় না। সে তার মতো করে জীবন কাটাচ্ছে।এমনকি আগুনের প্রতিও তার দৃষ্টিভঙ্গী বেশ বিস্ময়কর।‘আমার আগুন ভালো লাগে। আমি জানি যে লোকেরা অতীতে আগুনে পুড়েছে, তারা আগুনকে ভয় পায়। কিন্তু আমি এর মধ্যে ভয় পাবার কিছু দেখছি না। আগুন সুন্দর ।আমি আগুনের দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকতে পারি। আমার আগুনকে বন্ধুর মতো মনে হয়।’

‘আমি ফিনিক্সের সাথে নিজেকে মেলাতে পারি’—পৌরাণিক পাখি ফিনিক্সকেও লিওশার ভালো লাগে। পৌরাণিক কাহিনীতে আছে ফিনিক্স যখন মারা যায় তখন সে নিজেই নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং সেই ছাই থেকে তার পুনর্জন্ম হয়। তাই ফিনিক্স হচ্ছে অমরত্বের প্রতীক – মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনের জয়ের প্রতীক।‘আমি ফিনিক্সের সাথে নিজেকে মেলাতে পারি। আমি শিশু বয়সে আগুনে পুড়েছিলাম, কিন্তু তার পর আমিও এক অর্থে ছাই থেকে পুনর্জন্ম লাভ করেছি’- বলছেন লিওশা।

বাবার সাথেও যোগাযোগ আছে লিওশার—লিওশা এখন মস্কোতে থাকেন, সেখানেই লেখাপড়া করেন। তার পিতা – যিনি তাকে শিশু বয়েসে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেছিলেন – তিনি কিছুদিন আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। লিওশাও তার সাথে যোগাযোগ রেখেছেন।আমি লিওশাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – তিনি কি তার বাবাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন?আমার প্রশ্ন শুনে লিওশা বিস্মিত হলেন।‘এটা ঠিক ক্ষমা নয়। আমি তাকে অনেকদিন আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। এখন আমরা সেভাবেই কথা বলি – যেভাবে স্বাভাবিক দু’জন মানুষ কথা বলে।’‘আমি কখনো বাবাকে ঘৃণা করি নি। হয়তো সে-ই ভেবেছিল যে আমি তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে আছি। কিন্তু যখন আমি বুরিয়াটিয়া গেলাম, আমাদের দেখা হলো, কথা হলো – আমি তাকে সবই বললাম।’‘এখন আমরা শুধু পরস্পরকে চিঠি লিখি, যোগাযোগ রাখি’-বলছিলেন লিওশা।আগুনকে ভয় পায় না লিওশা সূত্র: বিবিসি বাংলা

ad

পাঠকের মতামত