235345

‘টাকা বেশি খরচ করো না বাবা আমি বিদেশে পড়তে যাব’

নিউজ ডেস্ক।। ‘বাবা টাকা বেশি খরচ করো না, আমি বিদেশে পড়তে যাব। আমি আন্তর্জাতিক মানের স্কলার হব।’ এভাবে বাবা দিলীপ অধিকারীকে পরামর্শ দিত রাজধানীর স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী অরিত্রী অধিকারী। মঙ্গলবার রাজধানীর শান্তিনগরে ‘শান্তি নিবাস’ নামের ফ্ল্যাটে আত্মহত্যা করে সে। অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী যুগান্তরকে বলেন, মেয়ে আমার অনেক মেধাবী ছিল। ওর রোল ১০-১২ মধ্যেই থাকত। আমার ছোট মেয়েও ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। ওরাই ছিল আমার সব কিছু। কিন্তু শিক্ষকদের অতিমাত্রায় কঠোরতার কারণে আমার মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। সে যে অপরাধ করেছিল তার শাস্তি হতে পারত। তার মানে এই নয় যে, তাকে স্কুল থেকে টিসি দিয়ে বের করে দিতে হবে।

দিলীপ অধিকারী বলেন, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যে এত নিষ্ঠুর হতে পারে তা আমার জানা ছিল না। অরিত্রী প্রিন্সিপাল ম্যাডামের পা ধরে পরীক্ষা দেয়ার জন্য কান্নাকাটি করলেও তিনি কোনো মতেই পরীক্ষা দিতে দেননি। ঘটনার দিনের কথা বর্ণনা দিয়ে দিলীপ অধিকারী বলেন, অরিত্রীকে পরীক্ষায় অংশ নিতে দেবে না এমন সংবাদ পেয়ে মেয়ে আমাদেরকে স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করে। এজন্য সোমবার স্বামী-স্ত্রী দুজনই ভিকারুননিসা স্কুলে যাই। কিন্তু স্কুলে আমাদেরকে পদে পদে অপমান করা হয়। স্কুলে ঢুকতেই ঘাম ছুটে যায়। স্কুলে গিয়ে প্রথমে ভাইস প্রিন্সিপালের রুমে যাই।

ভাইস প্রিন্সিপালের রুমে থাকা চেয়ারে বসতে গেলে তিনি বলেন, এগুলো শিক্ষকদের চেয়ার পাশে বেঞ্চ আছে সেখানে বসেন। বেঞ্চে ময়লা থাকা শর্তেও আমরা সেখানে বসি। এরপর অরিত্রীর কথা ওঠাতে তিনি ক্ষেপে গিয়ে বলেন, কেমন মেয়ে মানুষ করেছেন, পরীক্ষায় নকল করে? আমরা ওর ব্যাপারে গভর্নিং বডির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি; পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না। এ সময় আমরা মেয়ের হয়ে ক্ষমা চাই। কিন্তু তিনি কোনো কিছুই শুনতে রাজি হননি। তার কিছুই করার নেই জানিয়ে প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। এর পর অরিত্রীকে সঙ্গে নিয়ে প্রিন্সিপালের রুমে যাই। সেখানে যাওয়া মাত্রই প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বলেন, ‘ও আপনিই অরিত্রীর বাবা! ওর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাকে পরীক্ষা দিতে দেয়া হবে না। কেস ফাইল করা হয়েছে। কালকে এসে টিসি নিয়ে যাবেন। আমি তখন ম্যাডামকে মেয়ের হয়ে ক্ষমা চাই। এর মধ্যেই অরিত্রী ম্যাডামের পা ধরে কান্না করে ক্ষমা চায়। কিন্তু তিনি কিছুতেই অরিত্রীকে ক্ষমা করতে রাজি হননি। পরীক্ষায় অংশ নিতে দেননি।’

দিলীপ অধিকারী আরও বলেন, সোমবার সাড়ে ১২টা থেকে অরিত্রীর আরও একটি পরীক্ষা ছিল। ওই পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য খুব চেষ্টা করেছিল মেয়ে আমার। ম্যাডামের কাছে আমরা বারবারই অনুরোধ করেছি সন্তান ভুল করেছে, এবারের মতো ক্ষমা করে দিন। কিন্তু তিনি কোনোমতেই রাজি হননি। এর মধ্যে অরিত্রী ম্যাডামের রুম থেকে কখন যে বেরিয়ে যায় আমরা খেয়াল করিনি। মেয়েকে না পেয়ে কলেজের ভেতর অনেক খোঁজাখুঁজি করি। কিন্তু সবার একই পোশাক হওয়ায় বুঝতে অসুবিধা হয়। এর মধ্যে আমি তার মাকে বাসায় পাঠিয়ে দেই। মেয়ে বাসায় গেছে কিনা খোঁজ নিতে। অরিত্রীর মা বিউটি রানি বলেন, ‘আমি বাসায় পৌঁছে দেখি মেয়ে বাসায় এসে কান্না করছে। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি সব ঠিক হয়ে যাবে মা। এর মধ্যে সে তার নিজের রুমে ঢুকে বেডে শুয়ে পড়ে। আমি পাশের রুমে অরিত্রীর জন্য পেয়ারা কাটতে যাই। পেয়ারা নিয়ে যেতেই দেখি দরজা বন্ধ।

তখন আমি দৌড়িয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে অরিত্রীকে ডাকাডাকি করি। কোনো শব্দ না পেয়ে ওর বাবাকে জানাই। এর মধ্যে বাসার কাজের লোকজনকে ডেকে দরজা ভেঙে রুমে প্রবেশ করে দেখি ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে আমার মা।’ অরিত্রীর বাবা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি দৌড়াতে দৌড়াতে বাসার সামনে আসার পর দেখতে পাই তাকে কোলে করে গাড়িতে উঠানো হচ্ছে। সেখান থেকে কাকরাইলে ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে যাই। চিকিৎসকরা জানান, অরিত্রী আর বেঁচে নেই। বিশ্বাস না হওয়ায় সেখান থেকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানকার চিকিৎসকরাও একই কথা বলেন।

দিলীপ অধিকারী বলেন, ‘মেয়ে আমাকে বারবারই বলত বাবা টাকা-পয়সা নষ্ট করো না। আমি বিদেশে পড়তে যাব। কিন্তু আমার মেয়ের সেই স্বপ্ন শিক্ষক নামের হত্যাকারীরা গলাটিপে মেরেছে। আমি এ খুনিদের বিচার চাই।’ শান্তিনগর পীরের গলির ‘শান্তি নিবাস’ বাসার ৮ম তলার ফ্ল্যাটে অরিত্রীর রুমে গিয়ে দেখা যায় পড়ার টেবিলে বই-খাতা, কলম, স্কেল, রুলারসহ সবকিছু সুন্দর করে সাজানো রয়েছে। টেবিলের সঙ্গে একটি চেয়ারও রয়েছে। যে চেয়ারে বসে অরিত্রী পড়ালেখা করত। স্ বপ্ন দেখত দেশের পড়ালেখা শেষ করে উচ্চ শিক্ষা অর্জনে বিদেশে পাড়ি দেয়ার। লক্ষ্য ছিল বিশ্বমানের স্কলার হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই রয়ে গেল। নকল করার অভিযোগে শিক্ষক নামের পাষাণ্ডদের অমানুষিক আচরণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে অরিত্রীকে। তার মৃত্যুতে পুরো পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। অরিত্রীর দাদা বাবু রণজিত কুমার বলেন, ছেলে সন্তান না থাকায় কিছুটা আক্ষেপ ছিল বাবা-মায়ের। কিন্তু দুই মেয়ে সে অভাব পূরণ করে চলেছিল। বাবা-মায়ের নয়নের মণি ছিল তারা। অরিত্রীর এই মৃত্যু পুরো পরিবারকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিল। উৎস: যুগান্তর।

ad

পাঠকের মতামত