
ভিকারুননিসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর (১৫) আত্মহত্যার ঘটনায় ক্ষোভ-হতাশায় ফেটে পড়েছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ তুলেছেন তারা।অভিভাবক বলেন, ‘খুব শখ করে মেয়েকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু পড়াশোনার ব্যাপক চাপ ও কিছু কিছু শিক্ষিকার দুর্ব্যবহারের কারণে ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা।’তিনি বলেন, ক্লাসে অমনোযোগী হয়ে নোট তুলতে না পারায় তার মেয়েক এক শিক্ষক বলেন, ‘এই পাগল-ছাগলের বাচ্চা, তোরে যে কইছি তুই শুনছ নাই’।এ স্কুল থেকে পাস করে গেছে-এমন এক শিক্ষার্থীর বাবা বলেন, ‘এ স্কুলে বড় মেয়েকে পড়াতে গিয়ে পড়াশুনা কাকে বলে হাড়েহাড়ে টের পেয়েছি। তাই সুযোগ থাকলেও ছোট মেয়েকে এই স্কুলে ভর্তি না করিয়ে সরকারি একটি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি।’
তৃতীয় শ্রেণির এক শিশু শিক্ষার্থী জানায়, স্কুলের বোর্ডে শিক্ষিকার লেখা বুঝতে না পেরে কখনও প্রশ্ন করলে শিক্ষিকা তখন রেগে গিয়ে বলেন-‘চোখে দেখিস না, আজই চোখের ডাক্তার দেখাবি। বেয়াদব কোথাকার।’এর আগেও ছোট-খাট নানা বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময় বেইলি রোডে ওই স্কুলের শিক্ষকদের কাছ থেকে রূঢ় আচরণ পাওয়ার কথা বলেছেন এই অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা।শিক্ষকদের খারাপ আচরণের শিকার হয়েছেন, এমন এক অভিভাবক সেই অভিজ্ঞতার কথা সাংবাদিকদের সামনে বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অভিভাবকদের এভাবে স্কুলে ডেকে নিয়ে কটূ কথা শোনানো কোনোভাবেই মানা যায় না- বলেছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী অভিভাবকরা।
শিক্ষকদের এসব বিষয় সামালের ক্ষেত্রে সংবেদনশীল হওয়া উচিত বলে মনে করেন অরিত্রীর এক সহপাঠীর বাবা আসাদুজ্জামান, যিনি নিজেও ঢাকার একটি স্কুলের শিক্ষক। ভিকারুননিসার কিছু শিক্ষকের ব্যবহার শিক্ষকসুলভ নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা অভিভাবকরা তো আমাদের ছেলে-মেয়েদের জীবন দিয়েই ভালোবাসি। তারাও আমাদের ভালোবাসে। কেউ কারও অপমান সইতে পারি না।অরিত্রীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার সকাল থেকেই বেইলি রোডে স্কুলের সামনে জড়ো হন অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ১২টা থেকে নবম শ্রেণির পরীক্ষা চলার মধ্যে প্রতিষ্ঠানের বাইরে ও ভেতরে অবস্থান নেন তারা।
‘এ কেমন শিক্ষা, যার জন্য শিক্ষার্থীকে জীবন দিতে হয়?’, ’এ কি শুধু আত্মহত্যা?’, ‘আমরা আর অরিত্রী চাই না’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘সুইসাইড করা মানে প্রেমে ব্যর্থতা!’ প্রভৃতি লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ান বিক্ষুব্ধরা।অধ্যক্ষের অপসারণসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভের সময় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মঙ্গলবারের পরীক্ষা পেছানোর দাবিও জানান অভিভাবকরা।তাদের বক্তব্য ছিল, এই ক্লাসের শিক্ষার্থীরা তাদের একজনকে হারিয়েছে। শোক প্রকাশের জন্যও তো তাদের সময় দেওয়া উচিত। ওই ঘটনার পর তারা সেভাবে প্রস্তুতিরও সময় পায়নি।তবে স্কুলের অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস সাংবাদিকদের বলেছেন, পরীক্ষার সূচি ঠিকই থাকবে। যারা পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না, তাদেরটা পরে নেওয়া হবে।
তবে অভিভাবকদের একজন দিলারা চৌধুরী বলেন, সব পরীক্ষা ‘বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে’ শিক্ষার্থীরা।দায়ীদের শাস্তি এবং অধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবিতে বুধবার সকাল ১০টায় আবারও কলেজের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করবেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা।অরিত্রীর ক্লাসেই পড়ে সাহানা বেগমের মেয়ে। মঙ্গলবার তিনিও ছিলেন বিক্ষুব্ধ অন্য অভিভাবকদের সঙ্গে। সে সময় সাংবাদিকদের কাছে শিক্ষকদের ‘অকথ্য গালিগালাজ’ ও রূঢ় আচরণের কথা বলার এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন সাহানা।তিনি বলেন, আমাদের বাচ্চা যদি কোনো খারাপ কাজ করে আমরা কি সেটাকে সমর্থন দিই? বাচ্চাদের সঙ্গে যে আচরণ করে সেটা বলার মতো না। অভিভাবকদেরও ডেকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়।
সাহানা বলেন, নিজের অপরাধের জন্য বাবা-মায়ের অপমানের কারণেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে অরিত্রী। বাচ্চাদের বাবা-মায়েদের অপমান করে এমন স্কুল কোথাও নেই।সব শিক্ষক নয়, কিছু শিক্ষকের আচরণ অনেক রূঢ় মন্তব্য করে অভিভাবক আসাদুজ্জামান বলেন, এ ধরনের শিক্ষকদের সংশোধন হওয়া দরকার। অরিত্রীর বাবা-মাকে অপমানের সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।অরিত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে চেনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মোবাইল হয় তো সঙ্গে ছিল, কিন্তু এই ছাত্রী নকল করার মতো না। অরিত্রী অত্যন্ত মেধাবী ও সুশৃঙ্খল মেয়ে ছিল। উচ্ছৃঙ্খল হলে তো আত্মহত্যার দিকে পা বাড়াত না।
অরিত্রীর কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন দশম শ্রেণির সামিয়া হোসেন চৈতীও।শিক্ষকদের খারাপ আচরণের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবাই খারাপ না, অনেকের ব্যবহার খুব বাজে। অভিভাবকদের তো দোষ না, অভিভাবকরা প্রশ্রয়ও দেয় না। তাদেরকে কেন ডেকে এনে ঝাড়া হয়? আমরা চাই, এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটুক। স্কুলে যেন আমাদের মা-বাবাদের ডেকে অপমান করা না হয়।অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌসের আচরণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অভিভাবক দিলারা চৌধুরী; স্কুলের চতুর্থ ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে তার দুই মেয়ে।দিলারা চৌধুরী বলেন, আপনারা তো এতক্ষণ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন, কারও মুখ থেকে তার বিষয়ে ভালো কথা শুনেছেন? শোনার কথা না। কারণ উনি নানা ধরনের দুর্নীতিও করেন।
গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক নাসির উদ্দিনের নাম উল্লেখ করেই অভিযোগ তোলেন কয়েকজন অভিভাবক।তাদের একজন বলেন, ছেলে-মেয়েরা পরীক্ষা দিয়ে আসে আর দোয়া করে, আল্লাহ নাসির স্যারের কাছে যেন খাতা না যায়। কোচিং যারা করে না, তাদেরকে ফেল করে করিয়ে দেওয়া হয়। সে কারণে সবাই কোচিং করতে বাধ্য হয়।এর আগে গত রোববার স্কুলের প্রভাতী শাখার নবম শ্রেণির সমাজ পরীক্ষার সময়। স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, অরিত্রী অধিকারী পরীক্ষায় মোবাইল ফোনে নকল নিয়ে টেবিলে রেখে লিখছিলেন। কর্তব্যরত শিক্ষক তাকে ধরে ফেলেন। পরদিন অরিত্রীকে তার অভিভাবকদের স্কুলে নিয়ে আসতে বলা হয়। সোমবার দুপুরে ঢাকার শান্তিনগরের বাসায় নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেন অরিত্রী।
স্বজনদের দাবি, অরিত্রীর বাবা-মাকে ডেকে নিয়ে ‘অপমান করেছিলেন’ অধ্যক্ষ। সে কারণে ওই কিশোরী আত্মহত্যা করেছেন।এ ঘটনায় বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌসসহ পাঁচজনকে বরখাস্ত করার জন্য আইনি (লিগ্যাল) নোটিশ পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার অভিভাবকদের পক্ষে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতিকে নোটিশটি পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ।ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ছাড়াও আরও যাদের বরখাস্ত করতে বলা হয়েছে তারা হলেন, সহকারী প্রধান শিক্ষক জিনাত আক্তার (ইতোমধ্যে বরখাস্ত), শিক্ষক প্রতিনিধি মোস্তারি সুলতানা, ড. ফারহানা খানম ও মাহবুবুর রহমান মিঠু।