
নেপালে বিমান বিধ্বস্ত: আহতদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
নিউজ ডেস্ক।।
নেপালে ইউএস-বাংলার বিমান দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বাঁচলেও তাদের চোখে মুখে অন্ধকার। নেপালের কাঠমান্ডুর হাসপাতালের বেডে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। পাশাপাশি ভাবছেন, বাকি জীবন কীভাবে কাটাবেন। আনন্দের যাত্রা পঙ্গুত্বে রূপ নিয়েছে। কেউ হারিয়েছেন প্রিয়জনকে। আবার অনেকে এখনো জানেনই না তার পরিবারের কোনো সদস্যই আর বেঁচে নেই। শুধু এতটুকু জানেন তারা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। অনেকে স্বামী, সন্তান রেখে ফিরছেন নিজ জন্মভূমিতে।
দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়াদের একজন আলমুন নাহার অ্যানী। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছিলেন, প্লেনটি যখন দু’ভাগ হয়ে গেল আমি আহত হলাম। কিন্তু আমার ৩ বছরের বাবু প্রিন্ময়ীর তো কচি হাত-পা। ওর কী অবস্থা? তিনি এখনো জানেন না, তার সন্তান ও স্বামী কেউই বেঁচে নেই। এ অবস্থাতেই আজ শুক্রবার ফিরবেন দেশের মাটিতে। অ্যানী শুধু জানেন তারা চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর হাসপাতালে আছে।
নেপালের কাঠমান্ডুতে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় গতকাল দেশব্যাপী শোক পালন করা হয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, নেপালের কাঠমান্ডুর আকাশও ভারী হয়ে আছে ওই শোকে। নিহতদের স্বজন ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের সান্ত¦না দেওয়ার ভাষা নেই কারো। প্রায় একই চিত্র অন্যদের বেলায়ও। স্বজনদের কেউ কেউ মর্গের সামনে বসে আছেন, কেউবা বার্ন ইউনিট এবং আইসিইউর করিডোরে। তাদের মুছে গেছে চোখের পানিও।
উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৫১ প্রচারিত হলেও মূলত ৪৯ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ২৬ জনই বাংলাদেশি। আহত ১০ জন। তাদের মধ্যে ৭ জনের নেপাল ত্যাগের ছাড়পত্র মিলেছে। তাদের একজন শাহরীন আহমেদ গতকাল দেশে ফিরেছেন। আরও ৩ জনকে আজ শুক্রবার দেশে পাঠানোর কথা। তা ছাড়া উন্নত চিকিৎসার জন্য ইয়াকুব আলীকে নয়াদিল্লিতে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। এর আগে বুধবার রেজওয়ানুল হককে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছে। আর নিহতদের মরদেহ ঢাকায় পাঠাতে অপেক্ষা করতে হবে অন্তত ৫ দিন।
এদিকে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে নেপাল সরকার গঠিত কমিটির তদন্তকাজ চলছে। তবে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের সময় বিলম্বিত হতে পারে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী দুর্ঘটনার রহস্য জানতে অপেক্ষা করতে হতে পারে দেড় বছর। যদিও এ ধরনের তদন্তের জন্য ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অথরিটির (আইকাও) বিধানে ১ বছরের নিয়ম রয়েছে। উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার তদন্ত দলে নেপালের ৬ সদস্যের সঙ্গে বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ৩ সদস্য যুক্ত হচ্ছেন। কবে নাগাদ যুক্ত হবেন তা অবশ্য জানাতে পারেননি কেউই।
কাঠমান্ডুর বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস এ বিষয়ে গতকাল বিকালে আমাদের সময়কে বলেন, নেপাল সরকার আমাদের প্রতিনিধিদের যুক্ত করতে সম্মতি দিয়েছে। ফলে যৌথভাবেই চলবে তদন্তকাজ। তবে প্রতিবেদন প্রকাশ কবে হবে এর সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ এখনো বলার মতো সময় আসেনি। নেপাল সরকার ১ বছরের কথা বলেছিল, আমরা ৬ মাসের মধ্যে শেষ করতে বলেছি।
আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, তদন্তে এখন পর্যন্ত কী আভাস মিলেছে তা প্রতিবেদন প্রকাশের আগে জানা সম্ভব নয়। হতাহতদের নিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, ময়নাতদন্ত এখনো চলমান। পুড়ে যাওয়া অন্তত ৫ জনের জন্য ডিএনএ টেস্ট করা লাগতে পারে শনাক্তকরণে। সেই প্রক্রিয়া শেষ করতে সর্বোচ্চ ২১ দিনের সময়ের ব্যাপার আছে। নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশি কারা তাদের চিনতেও ততক্ষণ অপেক্ষা করা লাগতে পারে। অবশ্য বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ থেকে একটা মেডিক্যাল টিম এসেছে।
এদিকে কাঠমান্ডুর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে স্বজনদের ব্যাকুলতা।
আহতরা কাতারাচ্ছেন হাসপাতালের বেডে। আহতদের অবস্থা দেখে তারাও কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। তাদের ভাগ্যে আসলে শেষ পর্যন্ত কী আছেÑ সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউই। অবস্থা দেখে সাধারণ মানুষও চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না। তা ছাড়া পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া আপনজনদের দেখতে হাসপাতালের ফরেনসিক ল্যাবের সামনে স্বজনদের ব্যাকুলতা দেখা গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও জীবনহারা আপনজনদের দুদিনেও দেখার সুযোগ পাননি স্বজনরা। শুধুই অশ্রুপাত করছেন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন যাত্রীদের মধ্যে কাঠমান্ডু মেডিক্যাল কলেজে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছেন আইসিইউতে কবির হোসাইন, এমরানা কবির, শেখ রোবায়েত রশিদ। আর স্কলাসটিকা স্কুলের শিক্ষক শাহরীনকে গতকাল ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আজ দেশে যাচ্ছেন আলমুন নাহার অ্যানী, কামরুন নাহার স্বর্ণা এবং মেহেদী হাসান। এই তিনজনের সঙ্গে নেপাল রওনা হয়েছিলেন একই পরিবারের ৫ জন। অ্যানীকে রেখে পরপারে চলে গেছেন তার স্বামী ফটোগ্রাফার প্রিয়ক ও তার সন্তান প্রিন্ময়ী। বেঁচে যাওয়া মেহেদী তার স্ত্রী স্বর্ণা ও ফুফাতো ভাইয়ের স্ত্রী অ্যানীকে বাঁচিয়েছেন ঝুঁকি নিয়েই। তবে উড়োজাহাজের আগুনের ভয়াবহতার কারণে আর উদ্ধার করতে পারেননি বাকি দুজনকে।
কাঠমান্ডুর টিচিং হাসপাতালের ফরেনসিক ল্যাবের সামনে স্বজনরা মরদেহ শনাক্ত করার জন্য নির্ধারিত ফরম পূরণ করেছেন। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ২৪টির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হলেও পরিচয় শনাক্ত হয়নি একটিরও। স্থানীয় পুলিশের কড়াকড়ি আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বাধায় বারবার ফিরতে হচ্ছে স্বজনদের।
হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক প্রমোদ শ্রেষ্ঠা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পরিচয় নিশ্চিত হয়েই তারা মরদেহ হস্তান্তর করতে চান। শনাক্ত করতে চারটি দল কাজ করছে। এর মধ্যে দুটি দল ময়নাতদন্ত; একটি দল মরদেহের নমুনা নিয়ে পরিচয় জানার চেষ্টা করছে। আর অন্যটি পরিবারের স্বজনদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত। এ প্রক্রিয়ার পরও যদি পরিচয় নিশ্চিত না হওয়া যায় তা হলে ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে।
গতকাল দুপুরে কাঠমান্ডু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কথা হয় স্বজন আহমেদ শফিকের সঙ্গে। তার ভাই নজরুল ইমলাম সস্ত্রীক নিহত হন দুর্ঘটনায়। শফিক বলেন, ভাইয়ের সঙ্গে তার শেষ কথা হয় ওইদিন বাংলাদেশ সময় বেলা ১১টা ১৩ মিনিটে। বলছিলেন, ভাবিকে নিয়ে তিনি নেপাল যাচ্ছেন।
এদিকে গতকাল দুপুরে নেপাল পৌঁছেছেন ঢাকা থেকে যাওয়া মেডিক্যাল টিমের প্রতিনিধি দল। তারা হলেনÑ ঢামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. লুতফর কাদের লেনিন, ঢামেকের সহকারী অধ্যাপক ডা. হোসেন ইমাম, অধ্যাপক ডা. মনসুর রহমান, ডা. একেএম ফেরদৌস রহমান ও ডা. মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) সহকারী অধ্যাপক ডা. মুশফিকুর রহমান, ডা. রিয়াদ মজিদ ও সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. রাজিব আহমেদ, অ্যাডিশনাল সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ (ক্রাইম সিন, সিআইডি) আবদুস সালাম ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিএনএ স্পেশালিস্ট (সিআইডি) আশরাফুল আলম। বিমানবন্দর থেকে তারা প্রথমে যান কাঠমান্ডুর বাংলাদেশ দূতাবাসে। এর পর রাষ্ট্রদূত ব্রিফিং করেন গণমাধ্যমকে। উৎস: দৈনিক আমাদের সময়।