
আহা! বিদায় শুধু পাঁচ দিনের জন্য নয়, অনন্তকালের …
ভ্রমণ পাগল পিয়াস রায় বিমানে ওঠার আগে হজরত শাহ্জালাল বিমানবন্দরে বসে সেলফি তুলে ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘টাটা মাই কান্ট্রি ফর ফাইভ ডেইজ’। শুধু তাই নয়, মোবাইল ফোনে মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলেন তিনি। কে জানত শুধু পাঁচ দিনের জন্য দেশ নয়, অনন্তকালের জন্য পিয়াসকে পৃথিবী ছাড়তে হবে।
গতকাল মঙ্গলবার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের তালিকা। সেখানে পিয়াসের নাম রয়েছে। এ খবর জানতে পেরে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার দাড়িয়াল ইউনিয়নের মধুকাঠি গ্রামে চলছে আহাজারি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পিয়াস বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার দাড়িয়াল ইউনিয়নের মধুকাঠি গ্রামের বাসিন্দা বাবা সুখেন্দু বিকাশ রায়, মা পূর্ণা রানি মিস্ত্রি ও বোন শুভ্রা রায়ের আর্তনাদে পুরো গ্রাম শোকে স্তব্ধ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বরিশাল নগরের নতুনবাজারস্থ মথুরানাথা পাবলিক স্কুলসংলগ্ন একটি ভবনের চতুর্থতলার একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন পিয়াস। তিনি গোপালগঞ্জের শেখ সাবেরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজের এমবিবিএস কোর্সের শেষ বর্ষে ছাত্র ছিলেন। পাশাপাশি তিনি ওই মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন।
বাবা সুখেন্দু বিকাশ রায় বলেন, ‘আমাদের এক ছেলে ও এক মেয়েসন্তান। দুজনের মধ্যে পিয়াস বড়। সে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকা নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। পরবর্তী সময়ে গোপালগঞ্জের শেখ সাবেরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজের এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হয়। এ বছর শেষে এমবিবিএস কোর্সে শেষ বর্ষের পরীক্ষা সম্পন্ন করে। নেপালে ঘুরতে গিয়েছিল।’
বাবা সুখেন্দু আরো বলেন, পিয়াস এসএসসি পরীক্ষার পর থেকে অবসর সময়ে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াত। এর আগেও ভারতে ছয়বার ও নেপালে দুইবার গিয়েছিল। কয়েক দিন আগে তার মেডিক্যাল কলেজের শেষ বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষা দিয়েই ঘুরতে প্রথমে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পরে সে নেপালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
মা পূর্ণা রানি মিস্ত্রি বলেন, ‘রবিবার রাতে বরিশাল থেকে লঞ্চযোগে ঢাকায় যায় পিয়াস। ওকে লঞ্চঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। পরের দিন সকালে ঢাকায় চাচাতো ভাইয়ের বাসায় গিয়ে ওঠে। সেখান থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান নেপালের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করার জন্য।’ তিনি বলেন, বিমানে ওঠার আগে সোমবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সর্বশেষ ছেলের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তখন পিয়াস জানিয়েছিল সে কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেনে উঠবে। এরপর আর কোনো খবর তার পাওয়া যায়নি। কাঠমাণ্ডুতে এ দুর্ঘটনার পর থেকে আর পিয়াসের কোনো খোঁজ পাননি। শুনেছেন সে মারা গেছে।
ক্রন্দনরত সন্তান হারা ওই মা বলেন, ‘আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব। ওই ছিল আমাদের ভরসার মানুষ। তাকে নিয়ে অনেক স্বপন দেখতাম। সেই স্বপ্ন আমার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’
পিয়াসের বোন শুভ্রা রায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রওনা দিয়ে কাঠমাণ্ডুতে দুপুর সোয়া ২টায় পৌঁছানোর কথা ছিল। এই প্লেনে আগামী ১৬ মার্চ বিকেল ৩টায় কাঠমাণ্ডু থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার কথা ছিল। সে ফিরতি টিকিট নিয়ে গিয়েছিল। দুটি টিকিটই অগ্রিম কাটা ছিল।’
বোনজামাই শুসময় সরকার বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ভ্রমণপিপাসু পিয়াস ছুটি পেলেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়ত দেশ থেকে দেশান্তরে। আর আজ সেই ভ্রমণই তার বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাকে অনিশ্চিত করে দিয়েছে।’
পিয়াসের মেডিক্যাল কলেজ শোকে স্তব্ধ
আমাদের গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গোপালগঞ্জ শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজ এখন শোকে স্তব্ধ। মেধাবী পিয়াসকে হারিয়ে শিক্ষক-সহপাঠীরা শোকে কাতর। কলেজের এমবিবিএস ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিলেন পিয়াস। পরীক্ষা শেষে নেপালে ঘুরতে গিয়ে যে আর কোনোদিন ফিরবেন না তা কে ভেবেছিল।
পিয়াসের মৃত্যুতে গতকাল মঙ্গলবার ওই মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ক্লাস ও একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়।
শোক পালন করতে গতকাল সকাল ১০টায় কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কালো ব্যাজ ধারণ করে ক্যাম্পাসে এক মিনিট নীরবতা পালন করে। সন্ধ্যায় কলেজ ক্যাম্পাসে মোমবাতি প্রজ্জ্বালন করে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করা হয়।