
অপেক্ষা: ব্ল্যাক বক্স ডি-কোডের
নিউজ ডেস্ক।।
নেপালের কাঠমাণ্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ‘ব্ল্যাক বক্স’ উদ্ধার করা হয়েছে। ব্ল্যাক বক্সে ককপিটের যাবতীয় কথাবার্তা ও উড়োজাহাজের কারিগরি তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবেই রেকর্ড হয়ে থাকে। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার কারণ জানতে এখন নির্ভর করতে হচ্ছে এটির ওপর। এতে রক্ষিত ডাটা ও অডিও ভাষ্য যাচাইয়ের মাধ্যমে জানা যাবে দুর্ঘটনার নেপথ্য কারণ।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের বিমানটি নেপালে দুর্ঘটনার শিকারের কয়েক ঘণ্টা পরই ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ে পাইলট ও এটিসি (এয়ার টাওয়ার কন্ট্রোল) কথোপকথন। তিন মিনিটের এই কথোপকথনের সত্যতা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে ব্ল্যাক বক্সের তথ্যের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের জিএম (মার্কেটিং সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) কামরুল ইসলাম।
রাজধানীর বারিধারায় ইউএস-বাংলা কার্যালয়ে গতকাল মঙ্গলবার এক প্রশ্নের জবাবে কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বিমানের ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করা হয়েছে। এটি আইকাওর (আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ) হাতে যাবে। আইকাওয়ের প্রসিডিংস আছে। ব্ল্যাক বক্সের রেকর্ডিং রিড করে জানা যাবে।’
এদিকে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান বলেন, ‘বিধ্বস্ত ড্যাশ-৮ বিমানটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল না। বিমানটির ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানও বৈমানিক হিসেবে দক্ষ ছিলেন। নেপালের একজন সাবেক সচিবের নেতত্বে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তার পরও আমরা তিন সদস্যের একটি দল সেখানে পাঠিয়েছি। ব্ল্যাক বক্সের তথ্য ডি-কোড করার পরই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। সেটা গোপন করার কোনো সুযোগ নেই।’
কী থাকে ‘ফ্লাইট রেকর্ডারে’ : ব্ল্যাক বক্সকে এভিয়েশন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ‘ফ্লাইট রেকর্ডার’ নামে উল্লেখ করে থাকেন। যুদ্ধবিমান, যাত্রীবাহী বিমান, পণ্য পরিবহন বিমানসহ সব হেলিকপ্টারে ব্ল্যাক বক্স থাকে। এই ইলেকট্রনিক্যাল ডিভাইসটিতে ফ্লাইটের মধ্যবর্তী সময়ের কথোপকথন, ভিডিও, বিমানের গতিবিধি—সব কিছুই জমা হয়। ?ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডারে বিমানের ত্বরণ, গতি, উচ্চতা, বিমানের বাইরের ও ভেতরের তাপমাত্রা ও চাপ, ইঞ্জিনের দক্ষতা সম্পর্কিত তথ্যসহ ১০০ ধরনের তথ্য রেকর্ড হয় ব্ল্যাক বক্সে। এটি ‘ব্ল্যাক বক্স’ হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটির আসল রং হালকা কমলা হয়ে থাকে। রাতেরবেলায় ব্ল্যাক বক্স সহজে চিহ্নিত করতেই এমন রংকরণ। অনেকের মতে—দুর্ঘটনা, মৃত্যু ইত্যাদির কারণে এটিকে ব্ল্যাক বক্স নামে ডাকা হয়।
কেন নষ্ট হয় না ব্ল্যাক বক্স : বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়লে, কিংবা ক্রাশ করে পানিতে পড়ে গেলে ব্ল্যাক বক্স খুঁজে বের করতে আন্ডারওয়াটার লোকেটর বেকন ব্যবহার করা হয়।
এভিয়েশন বিশ্লেষক ও দ্য বাংলাদেশ মনিটর পত্রিকার সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘একটি ব্ল্যাক বক্স অভিকর্ষের চাপের তুলনায় প্রায় তিন হাজার ৪০০ গুণ বেশি চাপ সহ্য করে থাকে এবং একটানা ৩০ মিনিট এক হাজার ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। এমনকি ২০ হাজার ফুট পানির নিচেও কাজ করে যায় এটি। পানির নিচে ৩০ দিনের মতো এটি সচল থাকে। তাই যত বড় দুর্ঘটনাই হোক, ব্ল্যাক বক্স কখনো নষ্ট হয় না।’
বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন নাসিমুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ব্ল্যাক বক্স থেকে ডাটা ডিকোডিং করতে ক্ষেত্রবিশেষে মাসখানেকও লেগে যায়। নেপালে দুর্ঘটনাকবলিত উড়োজাহাজের ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার হয়েছে। এখন সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এটি যারা ডাটা ডিকোড করবে, তাদের কাছে নিয়ে যাবে।’ তিনি জানান, ব্ল্যাক বক্সের মাধ্যমে পাইলটের গায়ের রং ছাড়া সব তথ্যই পাওয়া যাবে।
ব্লাক বক্সের আবিষ্কার : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ ধরনের যন্ত্র তৈরির উদ্যোগ প্রথম নেওয়া হয়। অস্ট্রেলীয় সরকারের অ্যারোনটিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে কেমিস্ট ডেভিড ওয়ারেন এটি আবিষ্কার করেন। ১৯৬২ সালের ২৩ মার্চ প্রথম অস্ট্রেলিয়ার একটি বিমানে পরীক্ষামূলকভাবে এটি ব্যবহার করা হয়। স্টেইনলেস স্টিল বা টাইটানিয়ামের খোলস দিয়ে বক্সের আবরণ তৈরি করা হয়। টিকে থাকার অনেক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরই ব্ল্যাক বক্সগুলোকে উড়োজাহাজে সংযুক্ত করা হয়।
আধুনিক ব্ল্যাক বক্সগুলো ২৫ ঘণ্টা পর্যন্ত বিমানের ফ্লাইট ডাটা ধারণ করে রাখতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর ভেতর অনেক মেমরি চিপ পাশাপাশি সাজানো থাকে। এখানে তথ্য সরবরাহ করার জন্য বিমানের বিভিন্ন জায়গায় অনেক সেন্সর লাগানো থাকে। এসব সেন্সর অনবরত বিমানের গতি, তাপমাত্রা, সময়, ভেতর-বাইরের চাপ, উচ্চতা ইত্যাদি বিমানের সামনের দিকে থাকা ফ্লাইট ডাটা অ্যাকুইজিশন ইউনিট নামের একটি অংশে পাঠাতে থাকে। সেখান থেকে সেসব তথ্য চলে যায় ব্ল্যাক বক্সে।