
‘গর্জে উঠি, বলি কেউ তার গায়ে আর একটি আঁচড়ও দেবেন না’
সোমবার সকাল ১১টা। পায়ে হেঁটে অতিক্রম করছিলাম গণিবেকারি এলাকা। গুডস হিলের সামনে পৌঁছতেই চোখ আটকে গেলো এক কিশোরকে ঘিরে মানুষের জটলায়। কাছে যেতেই স্পষ্ট হলো ব্যাপারটি- কিশোর ছিনতাইকারী হাতেনাতে ধরা পড়েছে। তাই আর রক্ষা নেই। গণপিটুনিতেই প্রাণ যাবে! যাওয়া উচিত- একশ্রেণীর মানুষের এমন পৈশাচিক মনোবৃত্তি থেকে মুক্ত নয় এই কিশোর ছিনতাইকারীও। শুরু হয়ে গেছে তার ওপর বর্বর নির্যাতন, নারকীয় উল্লাস। উপস্থিত অনেকে শিশুটিকে মেরে-কেটে ভর্তা বানানোর পক্ষে। কিন্তু নাইন-টেনপড়ুয়া স্কুল ড্রেস পরা কিছু ছাত্রের মুখ মলিন, বিষণ্ন। তারা চাইছে না ছেলেটিকে এভাবে মারা হোক। সাহস করে কিছু বলতেও পারছে না তারা।
আমার মনে পড়ে গেলো সিলেটের কিশোর রাজনের কথা। যাকে চুরির দায়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছিল নরপশুরা। কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া নওগার আকবরপুর ইউনিয়নের ঘটনাটি আরো করুণ। দু্ই লোক মিলে এক কিশোরের পা দুটি বেঁধেছে মোটা বাঁশের কঞ্চির সঙ্গে। বাঁশের দুই দিক কাঁধে নিয়েছে লোক দুটি। মাঝখানে ঝুলছে কিশোরের নিন্মগামী দেহ। রশি দিয়ে ঝুলানো পা দুটি ওপরে, আর মাথা ঝুলছে নিচের দিকে। আরেক যুবক সর্বশক্তি প্রয়োগে লাঠি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করছে কিশোরের পা দুটি। অপরাধ কিশোরটি পকেট কেটেছে।
পুলিশ না আসলে হয়তো বাঁচানো যেতো না তাকে
আমি স্পষ্টত এই দুটি অমানবিক দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি এই কিশোরের বেলায়। এখনই এগিয়ে না গেলে এই কিশোরেরও সেই পরিণতি হবে। তাই আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে গর্জে উঠি, বলি কেউ আইন হাতে তুলে নিবেন না। ছিনতাইকারীর শাস্তি আছে, বিচার আছে। কেউ তার গায়ে আর একটি আঁচড়ও দেবেন না- বলেই কোতোয়ালী থানার ওসি জসিম উদ্দিনকে ফোন দিলাম। কখন লাউড স্পিকার অন হয়ে আছে আমি জানি না। জসিম ভাই ফোন ধরেই ওপ্রান্ত থেকে বললেন, ‘আজাদ ভাই ক্যান (কেমন) আছন (আছেন), কী খেদমত গরিত (করতে) পারি হঅন (বলেন)’। বুঝতেই পারছি আমার ব্যক্তিগত নম্বরটি তার সেভ আছে। পুরো কাহিনীটি শুনে তিনি জানতে চাইলেন টিম পাঠাবেন, নাকি আমি পাঠিয়ে দেবো।
এ সময় পাশের কিউসি পেট্রোল পাম্পে আমার গাড়ি সার্ভিসিং হচ্ছে। সার্ভিসিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে মনে করে বললাম, আমিই গাড়িতে করে নিয়ে আসছি। যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে এক মিনিটও এখানে রাখা নিরাপদ নয়, অতি উৎসাহীরা শকুনের মতো টেনে নিয়ে ছেলেটিকে মেরে ফেলতে পারে- সেই আশঙ্কায় নিজের গাড়িতে করে নিয়ে যাবার কথা বলি জসিম ভাইকে। ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে জানলাম আমার গাড়ি রেডি হতে আরো ২০ থেকে ৩০ মিনিট লাগতে পারে। তা ছাড়া গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়াটা বোকামি হবে-চট করে মাথায় আসলো বিষয়টা।
আমি বুঝতেই পারছি, এখানে এক মিনিটও নিরাপদ নয় ছেলেটি। এখন কী করা। আবার ফোন দিলাম ওসি জসিমকে। বললাম, ভাই আমি আনতে পারছি না, আপনি দ্রুত টিম পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। বলেই এবার ডায়াল করলাম সহকর্মী শরীফুল রুকনকে।
এসি কোতোয়ালী জাহাঙ্গীর সাহেবের নম্বর আমার কাছে নেই। তাই সংক্ষেপে বিষয়টি জানিয়ে রুকনকে বললাম জাহাঙ্গীর সাহেবকে বিষয়টি অবগত করতে।
বুঝতে পারছি পুলিশ আসতে আরো কিছুক্ষণ লেগে যাবে। কিন্তু একশ্রেণীর মানুষের কৌতুহল, ক্ষোভ কমছে না। তাই ছেলেটিকে টেনে পেট্রোল পাম্পের ভেতরে নিয়ে গেলাম, তার জন্য সেফ জোন গড়ে তোলার চেষ্টা করি। পাম্প কর্তৃপক্ষের একজন এসে বললেন, তাদের বাউন্ডারির মধ্যে কোনো গ্যাদারিং করা যাবে না। ছিনতাইকারীটিকে নিয়ে এখনই বের হবার তাড়া, তাগাদা তাদের।
কিশোর হলেও ছিনতাইকারীটির বড় ভাই বা কোনো নেতা থাকতে পারে। হতে পারে সে সংঘবদ্ধ ছিনতাইচক্রের সদস্য। রাস্তায় দাঁড়ালে তাকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে। অপরদিকে বিক্ষুব্ধ জনতা ফের আইন হাতে তুলে নিতে পারে। এই ভেবে আমি পেট্রোল পাম্প থেকে ছেলেটাকে বের করতে চাইছি না।
অবশ্য পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় কথোপকথন শুনে এরইমধ্যে আমার পক্ষে অবস্থান নিতে শুরু করেছে অনেকেই, ভারি হচ্ছে আমার দল। পেট্রোল পাম্প কর্তৃপক্ষকে তারাই বোঝাল যে, পুলিশ না আসা পর্যন্ত ছেলেটি এখানেই থাকবে। মিনিট ১০ পর পুলিশের টহল টিম এসে হাজির।
কোতোয়ালী থানার এস আই আব্দুর রহিম বললেন, তাদেরকে এসি জাহাঙ্গীর সাহেব পাঠিয়েছেন। ছেলেটাকে নিরাপদে পুলিশের গাড়িতে তুলে দিলাম। ১৭ শ ৭৫ টাকাভর্তি একটি ভেনিটি ব্যাগ বুঝিয়ে দিলাম তাদের। এখন সাক্ষী হবার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত নিজেই সাক্ষী হলাম, পুলিশের খাতায় নাম-ঠিকানা লিখে দিলাম।
দেড় ঘণ্টার ঝক্কি ঝামেলা, হাসফাঁস শেষে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পেরে স্বস্তি পেয়েছি এটুকুই- আইনগতভাবে যা হবার হোক, প্রয়োজনে জেলে যাক। জনতার রুদ্ররোষ থেকে তো এ যাত্রায় বেঁচে গেলো ছেলেটি। এই মানবিক কাজটি করতে পারার আনন্দ পৃথিবীর অনেক আনন্দের চেয়ে সেরা আনন্দ, সেরা অনুভূতি। শ্রেষ্ঠ এই অনুভূতিটুকু আজ আমার সারাদিনের অর্জন, দিনভর ভালো থাকা।
নোট : কিশোরটি আমাকে জানিয়েছিল তার নাম আকাশ। তার বাবা নেই। মা আছে। মাস্টারপুল বউবাজার এলাকায় অসুখে কাতরাচ্ছে তার মা রিজিয়া বেগম। মার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা দরকার। সেই টাকার সংস্থান করতেই ছিনতাই করতে নেমেছিল সে। আজ সকাল থেকে জামালখান আইডিয়াল স্কুলে ওঁৎ পেতেছিল। সুযোগ পেয়ে এক মহিলার ভ্যানিটি ব্যাগ ছোঁ মেরে দৌড় দেয়। পিছু নিয়েও কেউ তাকে ধরতে পারেনি। ব্যাগ উঁচিয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে অবশেষে ধরা পড়লো গুডস হিলের সামনে অন্য পথচারীদের হাতে। ধরা পড়া, তাকে ঘিরে মানুষের জটলা, গণপিটুনির শিকার হওয়া এসবের কিছুই জানেন না ছিনতাইয়ের শিকার মহিলাটি।
ব্যাগে থাকা ১৭৭৫ টাকার (একটি ৫শ টাকার নোট, বাকি সব ১০, ২০ ও ৫০ টাকার নোট) সঙ্গে দুটি ভিজিটিং কার্ডের একটির পেছনে ‘মাই হাজব্যান্ড নম্বর দিয়ে একটি ল্যান্ড ফোন নম্বর ও ব্যাটারি গলি লেখা আছে। ইত্য বছরে তাতে ফোন করে জানার চেষ্টা করি তাদের কোনো ব্যাগ ছিনতাই হয়েছে কিনা। এক ভদ্রমহিলা ফোন রিসিভ করে জানালেন এধরনের কোনো ঘটনার কথা তিনি জানেন না।
সাংবাদিক আজাদ তালুকদারের ফেসবুক থেকে সংগৃহিত