
টালিগঞ্জের এক নম্বর নায়িকা!
আমার প্রথম ছবি ‘আবর্ত’র জন্য হিরোইন খুঁজছিলাম। বিয়ের কয়েক বছর কেটে গেছে এমন একজন বিবাহিত নারীর চরিত্র অনেক খুঁজেও টালিগঞ্জে কাউকে পেলাম না। হঠাৎ মনে হলো, একটু বাংলাদেশে খোঁজ করে দেখি তো! খুঁজলাম, কিন্তু মনের মতো পেলাম না। চ্যানেল আইয়ের একজন বললেন, ‘আপনি জয়া আহসানকে দেখতে পারেন।’ সরাসরি যোগাযোগ করার আগে ইন্টারনেটে খোঁজ করলাম। ওর প্রচুর নাটক দেখলাম। এর মধ্যে বেশ কিছু ভালো কাজও দেখলাম। একটা বিষয় লক্ষ করলাম, ভালো-মন্দ সব মিলিয়ে জয়া কোথায় যেন অদ্ভুতভাবে স্ট্যান্ড আউট করে যাচ্ছে। ও আটপৌরে সাধারণ মেয়ে থেকে নচ গার্ল—ওর একটা অদ্ভুত ‘রেঞ্জ অব অ্যাক্টিং’ আছে। এটা আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করল। নম্বর জোগাড় করে ফোন করলাম। জয়া তখন ঢাকা থেকে অনেক দূরে কোথাও শুটিং করছিল। আমার কথা তেমন কিছু বোঝেনি ও। তবে আমাকে অভিনেতা হিসেবে চেনে। বললাম, এটা আমার প্রথম ডিরেকশন। এরপর বেশ কয়েক মাস আমরা ফোনে কথা বললাম। তখনো আমাদের দেখা হয়নি। চরিত্র নিয়ে ওর সঙ্গে আলোচনা করতে করতে আমি অনেকটাই কনভিন্সড ছিলাম, চরিত্রটা জয়াই করবে। পরে যখন সামনাসামনি দেখা হলো তখন হান্ড্রেড পার্সেন্ট কনভিন্সড হলাম। ‘আবর্ত’র পাণ্ডুলিপিটা এক বছর ধরে লেখা হয়েছে। শুরু থেকেই আমি শিল্পীদের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাক্ট করতে ভালোবাসি। একেকটা করে দৃশ্য লেখা হতো আর জয়াকে পড়ে শোনাতাম। তখন তো হোয়াটসঅ্যাপ ছিল না, এক বছর আইএসডি কলে প্রচুর খরচা করতে হয়েছে। কিন্তু এই খরচাটা কাজে দিয়েছে। জয়ার মধ্যে অদ্ভুত কিছু গুণ আছে। নিজে যেহেতু অভিনেতা, আরেকজন অভিনেতাকে ভালো বুঝতে পারি। প্রতিটা শট দিয়েই বলত, ‘দাদা, আমি অভিনয় করছি না তো! চরিত্রটার মতো বিহেভ করছি তো?’ একজন শিল্পীর অভিনয়ের মূলমন্ত্র যদি এটা হয়, আমি যেটাই করি তা যেন বিহেভ করি, অভিনয় না হয়, অটোমেটিক সেই অভিনেতার প্রতি শ্রদ্ধা চলে আসে।
প্রশ্ন করে করে একজন পরিচালককে উত্ত্যক্ত করে দিতে পারে জয়া। যোগ্য পরিচালক না হলে জয়া আহসানকে নিয়ে কাজ করা ভীষণ মুশকিল। অশিক্ষিত পরিচালক তাঁকে হ্যান্ডল করতে পারবেন না।
শুটিংয়ের একটা দিনের কথা আমার মনে আছে, জয়ারও নিশ্চয়ই মনে থাকবে। ‘আবর্ত’তে জয়া থাকে যে বাড়িটায়, সেখানে শেষ দিনের শুটিং। লাঞ্চ ব্রেকের পর জয়ার আর মাত্র দুটি দৃশ্য বাকি। লাঞ্চ শেষ, ডুপ্লেক্স বাড়ির নিচতলায় কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ কান্নার আওয়াজ। মেকআপশিল্পী দৌড়ে এসে বলল, ‘অরিন্দমদা, শিগগির এসো, জয়াদির কিছু একটা হয়েছে।’ গিয়ে দেখি, জয়া হাউমাউ করে কাঁদছে। বলল, ওর বাবা আর নেই। ওকে সামলাতে একটু সময় লেগেছে। একটু পর জয়া এসে বলল, ‘দাদা, তোমার সিনের কী অবস্থা? আগে কাজ শেষ করি, তারপর আমি যাব।’ তার আগেই আমি নিচে এসে ‘প্যাক আপ’ বলে দিয়েছিলাম। জয়াকে বলেছি, ‘অসম্ভব, এ অবস্থায় শুটিং করার প্রশ্নই ওঠে না। দরকার হলে শুটিং এভাবেই পড়ে থাকবে।’
যেকোনো শিল্পীর মধ্যে এমন ডেডিকেশন দেখলে ভীষণ শ্রদ্ধাবোধ চলে আসে। আমরা এমন একটা পেশায় আছি, এটা আমাদের কাছে শুধুই পেশা নয়, এটা আমাদের ধর্ম। একজন ফিল্ম মেকার হিসেবে আমার ধর্ম হিন্দু নয়, আমার ধর্ম সিনেমা। আমি সেটা বিশ্বাস করি। একই বিশ্বাস যখন অন্য কারো মধ্যে দেখি, প্রিয়জনের মৃত্যুর চেয়েও যার কাছে সিনেমাটা আগে—ডেফিনিটলি তাঁকে শ্রদ্ধা করতে হবে।
জয়ার মধ্যে অভিনয়ের অদম্য একটা স্পৃহা আছে, খিদে আছে। এত দিন ধরে অভিনয় করছে, তা-ও আরো ভালো কাজ করতে চায়। যেভাবে দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থেকে একটার পর একটা ভালো কাজ করে যাচ্ছে, সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। সামনে আরো ভালো কাজ করবে। বাংলাদেশ থেকে গিয়ে কলকাতায় ছবি করে ভারতবর্ষের প্রায় সর্বোচ্চ সম্মান ‘ফিল্মফেয়ার’ নিয়ে চলে এলো। জাতীয় পুরস্কার পাওয়াটা ওর ডিফিকাল্ট, কারণ বিদেশিদের এই পুরস্কার দেওয়া হয় না। তা না হলে ভারতের জাতীয় পুরস্কারটাও হয়তো ও পেত।
পাঁচ বছর আগে জয়াকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। শুধু শোনাই নয়, সে সময়কার সবচেয়ে বহুল প্রচলিত দৈনিক পত্রিকা থেকে বলা হয়েছিল, এই কাস্টিং নিয়ে কাজ করলে আমার ছবির কোনো কাভারেজ তারা করবে না, করেওনি। আমি একজন ফাইটার, সব সময় ফাইট করে গেছি। সে কারণেই জয়া আজকে এখানে, তার সঙ্গে আমিও। জয়াকে নেওয়ার সিদ্ধান্তটা অনেকেই মানতে পারেননি। আমার হিরোইন বান্ধবীরাও গোসসা করেছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তারাই এখন জয়ার প্রিয় বন্ধু। জয়াকে এখন টালিগঞ্জের এক নম্বর নায়িকা বললে ভুল বলা হবে না। আমার শুধু দুঃখ হয়, আরো কম বয়সে টালিগঞ্জে এলে অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে যেত জয়া। ও ভীষণ বুদ্ধিমতী। কোন ছবি করবে, কোনটা করবে না, খুব ভালো বোঝে। সৃজিত মুখার্জি, কৌশিক গাঙ্গুলির ছবিগুলো দেখলেই সেটা স্পষ্ট। ও সঠিক পথেই আছে। সৃজিত প্রায়ই বলে, ‘অরিন্দমদার বড় গুণ, তাঁর শিল্পীরা যখন ভালো কাজ করে, অরিন্দমদা তখন গর্ব বোধ করেন।’ কৌশিকের ‘বিসর্জন’-এর জন্য জয়া যখন একের পর এক পুরস্কার পেল, তখন আমার মনে হলো, জয়াকে এত দিন যে সাপোর্ট দিয়ে গেছি, জয়া সেটা এখন আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। ভীষণ আনন্দ হয়। আমার সঙ্গে ওর সম্পর্কটাই আলাদা। ‘আবর্ত’র পর আমার ‘ঈগলের চোখ’ করেছে। গল্প-চরিত্র সম্পর্কে কিছুই জানতে চায়নি। বলেছে, ‘জানার দরকার নেই।’ জয়া জানে আমি ওকে এমন কিছু করতে বলব না, যেটা ওর জন্য ভালো হবে না।
ওকে নিয়ে সামনে একটা বড় কাজ করার ইচ্ছা, প্রসেনজিৎও থাকবে। জয়া-বুম্বা দুজনই জানে সেটা। এখন করছি ‘বালিঘর’, এখানে জয়া নেই। যে বয়সের চরিত্রগুলো নিয়ে ছবিটা, জয়া সে বয়সটা পার করে এসেছে।
অসম্ভব রকমের একটা ওয়ারমথ আছে জয়ার মধ্যে। ওর ভেতরে একটা অদ্ভুত সুন্দর মানুষ আছে। কার সঙ্গে কতটা মিশতে হবে, ব্যালান্সটা কিভাবে করতে হবে, সেটা ও জানে।
জয়া যে মাপের শিল্পী, একটা সময়ে ও আমাদের এখানকার অপর্ণা সেন বা মাধবী মুখার্জিদের জায়গায় পৌঁছে যাবে।
অনুলিখন : দাউদ হোসাইন রনি
সূত্র: কালের কন্ঠ