
গাছকে বাঁচিয়ে রাখা সবচেয়ে বড় দায়িত্ব : শাকিব খান
দূর থেকে ভেসে আসছে কোকিলের ডাক। এমনই এক দুপুরে এফডিসিতে যাওয়া। চলচ্চিত্র অঙ্গনের শিল্পীদের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো। ঢাকাই চলচ্চিত্রের কিং খ্যাত নায়ক শাকিব খান সাত নম্বর ফ্লোরের রূপসজ্জা কক্ষে মেকাপ নিচ্ছেন।
মুখে রং-তুলির আঁচড় পড়বে—এমন সময় তিনিই শুরু করলেন কথা। কুশল বিনিময়ের পর শুটিং, বর্তমান ব্যস্ততা ও সিনেমার নানান বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময় চলল আলোচনা। মাত্র দুদিন বিশ্রাম নিয়েই ফের আরেকটি সিনেমার কাজ করছেন কথা হচ্ছে তার সঙ্গে।
সে ক্ষেত্রে কাজের মান ধরে রাখা কতটা কঠিন হচ্ছে?
শাকিব খান : আমি সব সময়ই চেয়েছি কোয়ালিটিফুল কাজ করতে। কোয়ানটিটি বাড়াতে চাইনি। বছরে দু-তিনটি সিনেমাই করতে চাই। যে সিনেমাগুলো আমার আইডেন্টিটি হয়ে থাকবে। আর এ সিনেমাগুলোই জাতীয় কিংবা আন্তজার্তিক স্বীকৃতি বয়ে আনবে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেতে হলে কোয়ানটিটি না কোয়ালিটিটাই বেশি দরকার। যে পথে অনেকটাই এগিয়েছে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি। আমাদের সবারই এখন কোয়ালিটির দিকে ঝোঁক দেওয়া উচিত। আমি আমার হাতের কাজগুলো শেষ করে এভাবে আর কাজ করতে চাই না।
তারপরও অনেক সময় অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে হয়। অনেকদিন ধরেই তো ইন্ডাস্ট্রিতে আছি, অনেকের সঙ্গেই সখ্যতা আছে। সেদিক থেকে কিছু কাজ করতে হয়। আর এতেই কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির জন্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমার ক্যারিয়ারের জন্য তো আছেই। খারাপ কোয়ালিটির কাজ করলে দর্শকেরা আমার চাইতে আরও বেশি হতাশ হয়। পরবর্তীতে একটা কোয়ালিটিফুল কাজের ক্ষেত্রে সেটা প্রভাব বিস্তার করে।
যখন আপনি অনুরোধের ঢেঁকি না গিলবেন, তখন তো অনেকেই মনোক্ষুণ্ণ হবেন, সে সময় কী করবেন?
শাকিব খান : কাউকে খুশি করা কিংবা মনোক্ষুণ্ণ করার দায়-দায়িত্ব তো আমি নিয়ে রাখি নাই। কোনো একজন খুশি হলেন কিংবা আরেকজন বিরাগভাজন হলেন, সেটির দিকে তাকালে তো আর ইন্ডাস্ট্রি সামনের দিকে যাবে না। দেখতে হবে অডিয়েন্স কতটা খুশি হচ্ছে।
আপনার ভালো কাজের সেরা উদাহরণ কী?
শাকিব খান : আমি যখন ‘শিকারি’, ‘নবাব’ করেছি কিংবা তারপরও বেশ কিছু কাজ করেছি। যারা আমাকে খুব কাছ থেকে জানেন, আমি ভালো কাজের জন্য কতটা মুখিয়ে থাকি, সেটা তারা জানেন। এখানে উদাহরণ দেওয়ার মতো কিছু নেই। আমি তো চাই, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে, ভালো কাজ করতে। যাতে বিশ্বের সিনেমা বাজারগুলোর সঙ্গে আমরাও সমানতালে এগিয়ে যেতে পারি।
এক একটা চরিত্রের জন্য অনেক পরিশ্রম করেন আপনি। চরিত্রটা হয়ে গেলে সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য কী কী করেন?
শাকিব খান : চেষ্টা করি কাজের মধ্যে বৈচিত্র ধরে রেখে ভালো কাজ করার। কিন্তু সব সময় একেবারে নিখুঁতভাবে করতে পারি না। একটি সিনেমা শেষ হওয়ার পর আরেকটি সিনেমা শুরু করতে তো মাঝখানে কয়েকটা দিন সময় দরকার। তারপরও যতটুকু সময় পাই এর মধ্যে প্রস্তুতি, গেটআপ, লুক, চরিত্রটি নিজের মধ্যে সেট করে নিই। আমি মনে-প্রাণে চাই না এখন আর এতটা কাজ করতে।
কলকাতার মতো একটি ইন্ডাস্ট্রিতে একটা সময় বিশ ত্রিশ লাখ টাকায় সিনেমা হতো, সেই দেশর একজন স্টার এখন একটি সিনেমাতে নেয় এক কোটি রুপি। তারা কিন্তু দুই বছরে তিনটি সিনেমা করেছে এমনও উদাহরণ রয়েছে।
একটা বিষয় নিয়ে বেশ চর্চা হচ্ছে যে, শাকিব দেশে নেই তো ইন্ডাস্ট্রিতে প্রাণ নেই। চলার পথে আসা বাধাগুলো অতিক্রম করে পথ চলার জন্য অনুপ্রেরণা যোগায় কোন বিষয়টি?
শাকিব খান : সৃষ্টিকর্তার বিশেষ রহমত, দর্শকদের ভালোবাসা। বড় গাছে হাওয়া বেশি লাগে, সেটা তো আমি অনেক বড় জায়গা থেকেই শুনেছি। এটা তো ক্যারিয়ারের অংশ। অনেক বড় লম্বা ইনিংস খেলতে হলে অনেক স্ট্রাগল করতে হবে। দর্শকদের জন্যই আমি আজ শাকিব হয়েছি, তাদের ভালোবাসাই আমার এসব বাধা অতিক্রম করার জন্য অনুপ্রেরণা যোগায়।
সিনেমার মার্কেট বর্তমানে খারাপ। কিন্তু চারদিকে এত ছবি হচ্ছে, আর সব ছবিই কী সফল?
শাকিব খান : যারা বলেন সব ছবি সফল সেটা শুধু বলার জন্যই বলা। শুধু তো আওয়াজ দিয়ে লাভ নেই। যারা ইন্ডাস্ট্রির খোঁজ-খবর রাখেন তারা জানেন কয়টা ছবি হিট আর কয়টা ব্যর্থ। এসব আওয়াজ না দিয়ে ভালো কনটেন্ট তৈরির দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। কারণ দর্শক দিন শেষে ভালো কনটেন্ট চায়। আর কন্টেন্ট ভালো না দিয়ে ছবি ব্যবসা সফল হবে সেটা ভাবাও ঠিক নয়।
গুঞ্জণ তো শাকিব খানের জীবনের নিত্যসঙ্গী, নতুন কোনো গুঞ্জন যখন শুনলে মেজাজ খারাপ হয় কী?
শাকিব খান : একটা কথা বলি, নায়করাজ আজ বেঁচে নেই। তিনি বলেছিলেন আমাকে, শাকিব যত দিন এসব থাকবে তত দিন বুঝবে তুমি ঠিক লাইনে আছ। তাই আমিও বিষয়টিকে ওভাবেই দেখি। অতটা মাথা ঘামাই না। পৃথিবীর সকল তারকাদের জীবন ঘিরেই নানান টাইপের গুঞ্জন প্রচলিত। ব্যক্তিজীবনে সেসবের কোনো ঠাঁই নেই। সময়ের সাথে সাথে পরিণত হওয়ার কারণে ওসব নিয়ে এখন আর মেজাজ খারাপ হয় না।
কয়েকদিন আগে ‘ভাইজান’ নামে নতুন একটি সিনেমায় অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন বলে জানতে পেরেছি
শাকিব খান : দ্বিতীয়বারের মতো বড় পর্দায় জুটি বাঁধতে যাচ্ছি আমি আর শ্রাবন্তী। ২ মার্চ থেকে শুটিং শুরু। এ কারণে আমি ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ছাড়ব। সিনেমাটি পরিচালনা করবেন জয়দীপ মুখার্জি। ছবিতে দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করব আমি। এতে পায়েল সরকার নামে আরেকজন নায়িকা থাকবেন। আর জয়দীপের পরিচালনায় এটি আমার চতুর্থ ছবি। এর আগে ‘শিকারি’, ‘নবাব’, ‘চালবাজ’-এ একসঙ্গে কাজ করেছি আমরা। ২৮ বছর আগের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ছবির গল্প। শাকিব-শ্রাবন্তী কিংবা শাকিব-শুভশ্রী জুটি, যেটাই হিট হোক। সে হিসেবে বলতে গেলে একদিকে ‘নবাব’, অন্যদিকে ‘শিকারি’।
যৌথ প্রযোজনার বাইরে দেশীয় প্রযোজনায় ‘আমি নেতা হবো’ ছবিটি নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে, সাথে সমালোচনাও
শাকিব খান : এটা তো অনেক ভালো একটা ব্যাপার। সেটাই তো আমরা চাই, দেশীয় ছবি একটা ভালো জায়গায় যাক। তারমধ্যে যে বিষয়টা থাকে যে দেশীয় ভালো ছবি করতে গেলেও ইন্ডিয়ার সাপোর্ট নিতে হয়েছে। ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর পরিচালক দীপঙ্কর দিপনের ইন্টারভিউ দেখলাম, তারও কিন্তু ইন্ডিয়ার সাপোর্ট নিতে হয়েছে। কারণ আমার এখানে নাই, কী করব? আমাদের এখানে তো এখন সংকট! টেকনোলজির দিক থেকে আমরা যে পিছিয়ে রয়েছি সেটাও ফ্যাক্ট।
তার জন্যে ‘হাম্বরা’ ভাব দেখিয়ে কী লাভ? যেটার শর্টেজ আছে সেটা তো আমরা নিতেই পারি। ‘নোলক’ সিনেমার পুরো শুটিং হলো হায়দ্রাবাদে। গল্প তো পুরোটাই বাংলাদেশের। শুটিং শুরুর আগে জিজ্ঞেস করলাম, সেখানে কেনো? ওরা বলল, সিনেমার বিষয় অনুযায়ী যে প্রপস দরকার সেটা সেখানে পাওয়া যাবে। আমরা যে প্রযুক্তির ব্যবহার করতে চাই, তা বাংলাদেশে চার ডাবল টাকা দিলেও পাব না। তাহলে আমি এখানে কেন শুট করব?
এফডিসিতে অনেক যন্ত্রপাতি আছে কিন্তু সে যন্ত্রপাতি চালানোর তো কেনো লোক নেই। দেখেন আমাদের এখানে ইনস্টিটিউশন না থাকার কারণে অনেকেই অনেক কিছু শিখতে পারে নাই। কিন্তু যারা বিজ্ঞাপন নির্মাণ করছে তারা কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের কাজের টেকনিক্যাল দিকটার উন্নতির জন্য। উন্নতির জন্য কথা আর রাজনীতি না করে ইন্ডাস্ট্রির ভালোর দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
অস্ট্রেলিয়ায় টানা ২৬ দিন ছিলেন। অনেকটা সময় নিয়ে ‘সুপারহিরো’ সিনেমার কাজ করলেন, সে অভিজ্ঞতা কেমন?
শাকিব খান : সেখানকার লোকেশন তো খুব সুন্দর। দেশে শুটিং করলে যে সাপোর্ট লাগে, দেশের বাইরে করলে তার থেকে আরও বেশি সাপোর্ট লাগে। তবে দেশের বাইরে কাজ করলে সময়ক্ষেপণ হয় না, একটানা মনোযোগ দিয়ে কাজ করা যায়। টেকনোলিক্যাল সাপোর্টটাও ভালো পাওয়া যায়। সেদিক থেকে বেশ ভালো। আমার কাছে মনে হয়, আরেকটি দুর্দান্ত প্রজেক্ট হতে যাচ্ছে।
‘চিটাগাইঙ্গা পোয়া ও নোয়াখাইল্লা মাইয়া’ অনেকদিন পর এমন টাইপের সিনেমা করছেন আপনি, এ ধরনের সিনেমার প্রতি দর্শকদের এক ধরনের আগ্রহও রয়েছে?
শাকিব খান : কমেডি নির্ভর ছবি তো, পুরো ছবিই এন্টারটেইনে ভরা। দর্শকেরা বেশ এনজয় করবে। এ ছবির গানগুলো চমৎকার হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ ধরনের গান আমার করা হয়নি! ২৩ মার্চ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে। তবে ‘চালবাজ’ ছবিটিও মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে। দেখা যাক কী হয়।
এই সময়ে সিনেমা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বটা কোথায় দিচ্ছেন?
শাকিব খান : কাজের কোয়ালিটিটা কত ভালো হবে, সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছি। এ বিষয়টা মাথায় রেখে এখন প্রজেক্ট হাতে নিচ্ছি। তবে এখনকার চাইতে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। আমার দুটি ছবি আন্তর্জার্তিকভাবে মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু আমার লোকাল কাজ করলেও ফুল সাপোর্টে যেন হয়, ভালো টেকনোলজি ও টেকনিশিয়ান যাতে থাকে। সে দিকটাতে আরও বেশি সিরিয়াস হব।
দেশের বাইরে যখন শুটিং করেন, তখন অবসর আপনার কীভাবে কাটে?
শাকিব খান : বাইরে শুটিং করলে সেভাবে আসলে সময় পাওয়া যায় না। আমি জানি ভালো কাজের জন্য আমার স্থির হওয়া দরকার। কিন্তু কি আর করার। খরচের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়। অবসর খুব একটা পাওয়া যায় না। যেভাবে কাজের রুটিন তৈরি করা থাকে তার বাইরে গিয়ে আড্ডা আর গল্পেই সময় কেটে যায়। খুব একটা সে গণ্ডির বাইরে বের হওয়ার সুযোগ থাকে না।
অবসরে বই পড়া কিংবা সিনেমা দেখার সুযোগ কী হয়?
শাকিব খান : হিন্দি, ইংলিশ, মালায়লাম ছবি দেখা হয়। যে কোনো দেশের যে কোনো ভালো ছবি হলেই দেখা হয়। আমি যখন এয়ারে থাকি তখন অন্যান্য ভাষার সিনেমা দেখি। অস্ট্রেলিয়া যেতে যেতে চার-পাঁচটা দেখছি। আবার আসতে আসতে চার-পাঁচটা দেখছি। সর্বশেষ সুবর্ণা আপার গহীন বালুচর আমার কাছে ভালো লেগেছে। বেশ স্মার্ট কাজ হয়েছে। আয়নাবাজিও বেশ ভালো লেগেছে, ঢাকা অ্যাটাকও।
কলকাতার ভীষণ জনপ্রিয় অভিনেতা প্রসেনজিৎকে নিয়ে একটি বই লেখা হয়েছে—‘বুম্বা শট রেডি’, লিখেছেন সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য। আপনার কি এমন কেন পরিকল্পনা আছে?
শাকিব খান : আরে বাবা! সৃষ্টিকর্তা কারও না কারও জন্য কিছু উছিলা করে রাখেন। আমি যা করছি, আল্লাহ আমাকে একটি মৃত প্রায় ইন্ডাস্ট্রির কথা বলেন, আমাকে দিয়ে তিনি একটা রোল করিয়ে নিচ্ছেন। বুম্বা দা যখন ইন্ডাস্ট্রি ওই লেভেলের ছিল, মানে ২৫, ৩০ হাজার রুপি সম্মানি নিতেন। সেই মানুষটি কিন্তু টুকটুক করে আজ ইন্ডাস্ট্রিকে এই জায়গায় নিয়ে আসছেন। যার কারণে ওখানকার সবাই তাকে বেশ সম্মান করেন। গাছ যদি বেঁচে থাকে আপনাকে ফল দেবেই। গাছকে বাঁচিয়ে রাখা সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।