200978

কী আছে খালেদা জিয়ার রায়ের কপিতে?

নিউজ ডেস্ক : গত ৮ ফেব্রুয়ারি এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। এছাড়া খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ পাঁচজনের দশ বছর করে কারাদণ্ড ও দুই কোটি ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়। আদালতে রায় ঘোষণার দীর্ঘ ১২ দিন পর মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি হাতে পেলেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।

সোমবার বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে ১১৭৪ পৃষ্ঠার রায়ের এ কপি পান আইনজীবীরা। বকশীবাজারে ঢাকা আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ ড. আখতারুজ্জামানের আদালতের কার্যালয় থেকে রায়ের অনুলিপি খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক উল্লেখ করেন, এই মামলার আসামিগণকর্তৃক পরস্পর যোগসাজসে সরকারি এতিম তহবিলের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার, ৬৪৩ টাকা ৮০ পয়সা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। খালেদা জিয়া ওই সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আসামি কাজী সলিমুল হক কামাল সংসদ সদস্য ছিলেন। আসামি কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী সরকারি কর্মচারী হয়েও খালেদা জিয়াকে সরকারি এতিম তহবিলের ব্যাংক হিসাব খুলে দিতে সহায়তা করা এবং পরবর্তীতে ওই হিসাব থেকে দুটি প্রাইভেট ট্রাস্টের অনুকূলে সরকারি অর্থের চেক বেআইনিভাবে প্রদান করায় বর্ণিত দুইজন আসামিকে অপরাধ করতে সহায়তার সামিল। আসামি তারেক রহমান, মমিনুর রহমান ও শরফুদ্দিন আহমেদ কৌশল অবলম্বন করে সরকারি তহবিলের টাকা একে অপরের সহযোগিতায় আত্মসাৎ করতে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছেন। এর মাধ্যমে এই মামলার ছয় জন আসামির প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে লাভবান হয়েছেন মর্মে অত্র আদালত মনে করেন। তাই আসামিরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধী হিসেবেও গণ্য হবেন বলে আদালত মনে করেন।

অর্থনৈতিক দুর্নীতি রাষ্ট্রের অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে এবং এর বাজে প্রভাব সমাজের প্রতিটি স্তরে সংক্রমিত হয় বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

দুই ধারার অপরাধ প্রমাণিত হলেও একটি ধারায় দণ্ড প্রদান সম্পর্কে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে খালেদা জিয়া ও ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী মিনস রিয়ো নিয়ে সরকারি এতিম তহবিলের টাকা দুই ভাগে ভাগ করে দুইটি ট্রাস্টের অনুকূলে হস্তান্তর করেন। যার মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট অন্যতম। ওই ট্রাস্টে ১৯৯৩ সালের ১৩ নভেম্বর ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা স্থানান্তরের পর ওই বছরের ১৫ নভেম্বর সেখানে জমা হয়। আসামি তারেক রহমান ও মমিনুর রহমান ট্রাস্টের নামীয় এসটিডি ৭ নং হিসেব থেকে টাকা উত্তোলন করে প্রথমে ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকায় ২ দশমিক ৭৯ একর জমি কেনেন। অবশিষ্ট টাকা প্রাইম ব্যাংকের গুলশান শাখায় স্থানান্তর করেন।

পরবর্তীতে কাজী সালিমুল হক কামাল ও গিয়াস উদ্দিনের হাত হয়ে আসামি শরফুদ্দিনের হাতে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬শ ৪৩ টাকা ৮০ পয়সা চলে যায় এবং তা আত্মসাৎ করা হয়। এগুলো সবই আসামিদের মিনস রিয়ো ইঙ্গিত করে। ফলে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (১) ধারায় বর্ণিত ক্রিমিনাল মিসকনডাক্ট এর উপাদান যেমন এই মামলায় উপস্থিত আছে, ঠিক তেমনি আসামিদের মিনস রিয়োসহ রংফুল গেইন এর উদ্দেশ্য বর্ণিত পরিমাণ টাকা বিভিন্ন পন্থায় রূপান্তর করে আত্মসাৎ করেছেন মর্মেও আদালত মনে করেন। খালেদা জিয়া এ মামলায় আত্মপক্ষ শুনানিতে বক্তব্য প্রদানের সময় নিজ জবানিতে স্বীকার করেছেন যে, তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ফলে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় তাকে শাস্তি দিতে কোনো বাধা নেই। আদালত মনে করেন, আসামিরা একে অপরের সহায়তায় যেভাবে টাকা আত্মসাৎ করেছেন তার একটি প্রিসামটিভ ভেল্যু রয়েছে এবং যা এই মামলা নিষ্পত্তির জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, আসামিরা অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ করে সরকারি এতিম তহবিলের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা ৮০ পয়সা আত্মসাৎ করেন। দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার বিধান পর্যালোচনা করলে লক্ষ্য করা যায় যে, ওই ধারায় সংঘটিত অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা যে কোনো বর্ণণার কারাদণ্ড বা যার মেয়াদ ১০ বছর পর্যন্ত হতে পারে এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হওয়ার বিষয়েও বিধান রয়েছে। প্রসিকিউশনপক্ষ থেকে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়ায় আসামি খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, মমিনুর রহমান, কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে কাজী কামাল এবং ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী উভয় আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার অধীনে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। তবে ১৮৯৭ সালের জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট এর ২৬ ধারার বিধান বিবেচনায় গ্রহণ করে পূর্বে বর্ণিত ৫ আসামিকে যে কোনো একটি আইনে দণ্ডিত করে আদেশ প্রচার করা বিধেয় হবে বলে আদালত মনে করে।

সকল আসামি সরকারি কর্মচারী এবং মর্চেন্ট কীভাবে হলো এ সম্পর্কে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার বিধান পর্যালোচনায় লক্ষ্যে করা যায় যে, এই ধারায় কোনো ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করতে হলে তাকে সরকারি কর্মচারী, ব্যাংকার, মার্চেন্ট বা এজেন্ট হতে হবে। পূর্বেই লক্ষ্য করা গেছে যে, এই মামলায় আসামি খালেদা জিয়া এবং কাজী সালিমুল হক ওরফে কাজী কামাল ঘটনার সময় জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন। জাতীয় সংসদ সদস্য বিদ্যামন আইন অনুসারে সরকারি কর্মচারী হিসেবে গণ্য হন।

আলোচনায় ইহাও লক্ষ্য করা গেছে যে, আসামি তারেক রহমান এবং মমিনুর রহমান প্রাইভেট ট্রাস্ট এবং ট্রাস্টি হলেও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুসারে ট্রাস্টিগণ সরকারি কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হন। আসামি শরফুদ্দীন আহমেদ মার্চেন্ট বা এজেন্ট হিসাবে গণ্য হন। ফলে তাদের সকলের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার বিধান প্রয়োগযোগ্য হবে বলে এই আদালত মনে করেন।

সরকারি এতিম তাহবিলে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬শ ৪৩ টাকা ৮০ পয়সা আত্মসাতের আসামিদের একে অপরের সহায়তা করায় দন্ড বিধির ৪০৯/১০৯ ধারার বিধান মোতাবেক সকলে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য মর্মে এই আদালত মনে করেন। আসামি শরফুদ্দীন আহমেদ ব্যতীত সকল আসামি সরকারি কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় প্রয়োগযোগ্য বলেও এই আদালত মনে করেন। আসামি শরফুদ্দীন আহমেদের ক্ষেত্রে ওই আইনের ৫ (২) ধারা প্রয়োগযোগ্য না হলেও দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারা প্রয়োগযোগ্য হবে। ফলে এই আসামি ছাড়া অপর আসামিদের ক্ষেত্রে ১৯৪৭ সানের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে ৫ (১) ধারায় বর্ণিত সকল শর্তাবলী প্রযোজ্য হবে বলে এই আদালত মনে করেন।

যুক্তিতর্ক শুনানির সময় খালেদা জিয়ার পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবী মওদুদ আহমদ বর্ণনা করেন যে, ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (১) ধারায় বর্ণিত ৫টি শর্ত ওই আসমির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তবে তিনি তার আলাচনার এক পর্যায়ে বলেছেন যে, তর্কেও খাতিরে হলেও ওই আইনের ৫ (১) (ডি) ধারায় বিধান প্রয়োগ করতে চাইলে উহার শর্তাবলী প্রসিকিউশন পক্ষের আসামি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞ কৌশলি উক্ত বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলা যায়। কেননা উক্ত ধারায় আইনের ৫(১)(ডি) ধারায় বিধান এই মামলায় প্রয়োগ করা যায়। সূত্র: বিডি নিউজ, যুগান্তর, সমকাল

ad

পাঠকের মতামত